স্বপ্নের বাড়ি : যে বাড়ি পানিতেও ভাসে

এক নজরে বাড়িটি সবুজে ঘেরা অন্যসব ছিমছাম শখের বাড়ির মতোই। অথচ আধুনিক নকশার কারণে এই বাড়ির প্রতি কোনায় যেন ছড়িয়ে আছে জলবায়ু-সহনশীল স্থাপত্যের জাদু।

তারিখ: 25 নভে. 2025

লেখক: নাফিসা ইসলাম, ইলমা ওয়াসীয়া আদৃতা

বাড়ি মানে কি শুধুই কয়েকটি ঘর, একটি স্থাপনা বা আশ্রয়? একটি আদর্শ বাড়ি কীভাবে গড়ে ওঠে? এমন বাড়ি যা ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা বা ভূমিকম্পে সহজে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। যার প্রতিটি ঘর হবে খোলামেলা, থাকবে আলো-বাতাসের অবাধ বিচরণ। ভীষণ গরমে ঘরের ভেতরে পাওয়া যাবে শীতল পরশ। শুধু যে থাকার জন্য আরামদায়ক তা নয়, সেইসঙ্গে প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগেও থাকবে নিরাপদ।

বন্যায় পানি ছুঁইছুঁই, তবে সেসময়ও নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার তাড়া নেই। কারণ বিশেষ কায়দায় বানানো এই বাড়িটি ঘরদোর, উঠান সব নিয়ে যেন পানিতে ভেসে উঠতে পারে। মনে হতে পারে এমন বাড়ি শুধু কল্পনাতেই সম্ভব। তবে এইরকম স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হয়েছে। যে প্রযুক্তির কল্যাণে এই বাড়ি বানানো হয়েছে তাকে বলা হচ্ছে ‘উভচর বাড়ি (অ্যাম্ফিবিয়াস হাউস)’।

বাড়িটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি হয়েছে। অত্যাধুনিক হলেও এর নির্মাণ সহজ এবং তা পরিবেশ বান্ধব। এই বাড়ির উঠোনের কথাই ধরা যাক। এখানে আছে অ্যাকুয়াপনিকস সেটআপ। অর্থাৎ ছোট জলাধার যেখানে মাছ জিইয়ে রাখা যায়। অনেকটা আগের দিনে মটকা বা বড় হাঁড়িতে যেমন কিছুদিনের জন্য মাছ রাখা যেত তেমন। সেখান থেকে পাইপ উঠে গেছে, তাতে বিশেষ কায়দায় গাছ লাগানো হয়। সেই গাছগুলোতে পাইপ দিয়ে দেওয়া হয় জলাধারের পানি। মাছ-গাছ দুই-ই এক জায়গায়।

বাড়িতে আরও আছে হাঁস-মুরগির খোয়াড়। বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে রাখার ট্যাংক। বিদ্যুতের জন্য ছাদে সৌরপ্যানেল। তাই যেকোনো দুর্যোগে আতঙ্ক নেই। অল্প জায়গায় এত কিছু করার অন্যতম কারণ হলো বন্যা বা অন্য কোনো দুর্যোগে ঘরবাড়ি সুরক্ষার সাথে থাকা-খাওয়ার নিরাপদ ব্যবস্থা।

স্বপ্নের বাড়ি

এক নজরে বাড়িটি সবুজে ঘেরা অন্যসব ছিমছাম শখের বাড়ির মতোই। অথচ আধুনিক নকশার কারণে এই বাড়ির প্রতি কোনায় যেন ছড়িয়ে আছে জলবায়ু-সহনশীল স্থাপত্যের জাদু।

ঘরের ভেতরেই শাকসবজির চাষ, জমিয়ে রাখা যায় বৃষ্টির পানি

উঠোন থেকে ঘরে গেলে দেখা যাবে এর দেয়ালগুলো বানানো মাটির ব্লক দিয়ে। একটি সাধারণ ইট তৈরিতে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয় তার ১০ ভাগের একভাগ হয় মাটির এই ব্লক তৈরিতে। পরিবেশের জন্য এ এক বিরাট আশীর্বাদ।

বাড়ি তৈরিতে ব্যবহৃত পরিবেশবান্ধব মাটির ব্লক

ঘরের জানালাগুলো বড় বড়। বাসার মাঝখান দিয়ে ডুপ্লেক্স বাড়ির আদলে ছাদে ওঠার জন্য আছে বাঁশের তৈরি সিঁড়ি। জানালা আর বাঁশের ফাঁক দিয়ে আলো আসতে তাই বাধা নেই। এই বাড়ির নকশাও এমন যেন ঘরের ভেতরে সবসময়ই স্বাভাবিক তাপমাত্রা থাকে। সে কারণে বাইরের আবহাওয়ার চাইতে অনেক সময় ঘরের ভেতর আরামদায়ক মনে হয়।

এক হিসেবে এই প্রযুক্তি আমাদের ঐতিহ্য আর ইতিহাসেরও ধারাবাহিকতা। মোঘল আমলের অনেক মহলের নকশা ও স্থাপত্যশৈলী এমন ছিল যা সেখানকার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করত। সেসব মহলের ভেতরে ঢোকার পরে আর কাউকে গরমে কষ্ট পেতে হতো না। তাজমহল কিংবা ঢাকার বুকে টিকে থাকা কিছু মোঘল স্থাপত্য বলি, সেসব স্থানে এই প্রাকৃতিক শীতাতাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা ছিল।

বড় জানালা, বাঁশের ফাঁক দিয়ে আসা আলো খেলা করে মাটির দেয়ালে

উভচর বাড়ি তৈরির নেপথ্যের ঘটনাটি বলা যাক। বেশ কয়েক বছর আগে উত্তরবঙ্গের তিস্তাপাড়ের অনেক বাড়িঘর সেবার বন্যায় তলিয়ে গিয়েছিল। বন্যার পানি ঘরে ঢোকার পরেও এক নারী সেখানেই থাকছিলেন। এই অবস্থায় একদিন তিনি রান্নাঘরে কাজ করছেন, হঠাৎই বাইরে কিছু পড়ার শব্দ শুনে দৌড়ে গিয়ে দেখেন তার শিশুসন্তান পানিতে পড়ে গেছে। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও শিশুটির আর খোঁজ মেলেনি।

এই করুণ ঘটনাটি স্কটল্যান্ডের ডান্ডি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনেস্কো সেন্টারের জলবায়ু পরিবর্তন ও অভিযোজন প্রধান ড. নন্দন মুখার্জিকে গভীরভাবে স্পর্শ করে । কী করা যেতে পারে এই ভাবনা থেকেই তিনি বন্যাকবলিত মানুষের সাথে কথা বলতে শুরু করলেন। তাদের অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজনের কথা জেনে নিয়ে এর দুই বছর পর তৈরি করেন স্বপ্নের বাড়ির এই নকশা।

এই বাড়ির সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তি হলো-পানি বাড়তে শুরু করলে বাড়ির নিচের ফাঁপা অংশ ধীরে ধীরে ভেসে ওঠে, ঠিক ভাসমান ভেলার মতো। চারকোনায় চারটি খুঁটি তীব্র স্রোতেও ভেসে থাকা বাড়িটিকে এক জায়গায় স্থির রাখে। পানি নামলে বাড়িটি আবার মাটির সমান পর্যায়ে নেমে আসে।

প্রশ্ন জাগতে পারে এত এত সুবিধা থাকা বাড়িটি তৈরিতে কি অনেক খরচ লাগে? দেখা গেছে এক বেডরুমের বাড়ি বানাতে খরচ পড়ে প্রায় ৫ লাখ টাকা। আর চার বেডরুমের বাড়ির জন্য দরকার হবে ২৫ লাখের মতো।

বন্যার সময় ভেসে ওঠে বাড়িটি, খুঁটিগুলো বাড়িটিকে স্রোতের মধ্যে স্থির রাখে

এই উভচর বাড়িটি বাংলাদেশে পাইলট প্রকল্প হিসেবে বাস্তবায়ন করেছে ইউনিভার্সিটি অব ডান্ডি ও রেজিলিয়েন্স সলিউশনস। কৌশলগত সহযোগী হিসেবে ছিল ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ (C3ER)।

জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ আমাদের দেশে এই ধরনের টেকসই, সাশ্রয়ী ও নান্দনিক বাড়ি হতে পারে সময়োপযোগী এবং আধুনিক সমাধান। ঢাকায় এই বাড়িটির একটি মডেল তৈরি করা হয়েছে। এরফলে মানুষ বাস্তবে দেখে তা তৈরির ধারণা পাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিশেষ করে বন্যার সময় নিরাপদে থাকার বিকল্প হিসেবে এই বাড়িটির কথা ভাবা যেতে পারে।

এই বাড়িটি দুর্যোগে দেবে নিরাপত্তা ও আশ্রয় আর জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে দিতে পারে আদর্শ সমাধান। দুর্যোগেও কাউকে আর ঘরছাড়া হতে হবে না। আদতেই এ এক স্বপ্নের বাড়ি।

নাফিসা ইসলাম ব্র্যাকের কমিউনিকেশনস ডিপার্টমেন্টে কমিউনিকেশনস স্পেশালিস্ট হিসেবে কর্মরত।

ইলমা ওয়াসীয়া আদৃতা ব্র্যাকের কমিউনিকেশনস ডিপার্টমেন্টে ইন্টার্ন হিসেবে কর্মরত।