সহকর্মী বাবাকেনিয়ে গর্ব

তারিখ: 14 মে 2020

লেখক: রাশা কবীর খান

মহামারির এই দুর্যোগের দিনে এর চেয়ে খুশির খবর আর হতে পারে না! ‘স্যার ফজলে হাসান আবেদ মূল্যবোধ পুরস্কার’ পেয়েছেন আমার বাবা, আমার ব্র্যাকের সহকর্মী ইকরামুল কবীর।

খবরটি পাওয়ার পর আমি এবং পরিবারের সকলে যে কী খুশি হয়েছি তা অবশ্যই ভাষায় বলে বোঝানো যাবে না। আত্মীয়-স্বজনসহ চেনা-জানা সবার কাছ থেকে অভিনন্দন আসছে তো আসছেই!। বাবাকে সহকর্মী হিসেবে কজনই বা পায়? এই সম্মাননা প্রাপ্তিতে ছেলে হিসেবে আমার আনন্দের কোনো সীমা নেই!

পুরস্কার পাওয়ার খবরটি শুনে বাবা যে যারপরনাই খুশি হয়েছেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমি জানি তাঁর আসল আনন্দ, আত্মতৃপ্তিটা কোথায়! তিনি ব্র্যাকের চাকরির ইন্টার্ভিউ থেকে শুরু করে গত ২৮ বছরের চাকরি জীবনে নানা সময়ে আবেদ ভাইয়ের সান্নিধ্য পেয়েছেন। কাজ করেছেন কমিউনিকেশনস বিভাগে, আবেদ ভাইয়ের সাথে একত্রে চেষ্টা করেছেন যোগাযোগের মাধ্যমে সমাজের বৈষম্যগুলো মুছে দিতে। ব্র্যাকই তাঁর জীবন, সেখানেই মিশে আছে তার ভালো লাগা।

আমি জানি, আবেদ ভাইয়ের জন্য বাবার মনে যে শ্রদ্ধাবোধ, যে ভালোবাসা রয়েছে তা অসীম। কাজকর্মে, আচার-আচরণে সবসময় আবেদ ভাইয়ের জীবনাদর্শকে ধারণ ও লালন করার মাধ্যমেই সেই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

বাবা ত্যাগে বিশ্বাসী। শ্রদ্ধেয় আবেদ ভাইয়ের কাছ থেকেই এই বিশ্বাস তাঁর মনে জন্মেছে। লন্ডনের আরাম-আয়েশের জীবনযাপন ছেড়ে আবেদ ভাই যুদ্ধপীড়িত বাংলাদেশের শাল্লায় এসে নিপীড়িত মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের লড়াইয়ে যুক্ত হয়েছিলেন। বাবা প্রায়ই বলেন, জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে নানা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে তিনি বহুবার এই গল্পটি স্মরণ করেছেন। আবেদ ভাইয়ের জীবনের নানা গল্পগাথা অন্য অনেকের মতো তার জীবনেও দাগ কেটে গেছে বারবার।

আমাদের বাসার দেওয়ালে হাতে গোনা যে দু-চারটি ছবি রয়েছে, তারমধ্যে একটি হলো আবেদ ভাইয়ের হাস্যোজ্জ্বল ছবি। বাবা মাঝেমধ্যেই ছবিটির সামনে দাঁড়িয়ে মিটমিট করে হাসেন। বাবার কাছে আবেদ ভাই যেন এক অলৌকিক শক্তি।

মূল্যবোধ পুরস্কার ব্র্যাককর্মীদের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার। ২০১২ সালে ব্র্যাকের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে প্রথম ‘মূল্যবোধ পুরস্কার’ প্রদান করা হয়েছিল। এরপর থেকে প্রতিবছর ব্র্যাক ডে-র বিশেষ দিনে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা ও পুরস্কার দেওয়া হতো। যারা সত্যিকার অর্থে জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে ব্র্যাকের মূল্যবোধসমূহকে ধারণ ও লালন করেন তাদের সম্মান জানাতে এবং ব্র্যাককর্মীদের অনুপ্রাণিত করতে প্রদান করা হয় এই সম্মাননা।

এই অসামান্য স্বীকৃতি পাওয়ার পরও মনে হয়, বাবার কোথায় যেন একটু আক্ষেপ থেকেই গেছে। যদি পুরস্কারটি আবেদ ভাইয়ের হাত থেকে পাওয়া যেত! তবে সদ্য প্রয়াত আবেদ ভাইয়ের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে এ বছর থেকে ব্র্যাক মূল্যবোধ পুরস্কারের নতুন নামকরণ করা হয়েছে ”স্যার ফজলে হাসান আবেদ মূল্যবোধ পুরস্কার”। বাবার আক্ষেপ যদি তাতে কিছুটা কমে!

ব্র্যাকের গল্প, আবেদ ভাইয়ের গল্প শুনতে শুনতেই তো আমরা বড় হলাম! অফিসের নানা ঘটনা প্রতিদিনই উঠে আসে আমাদের খাবার টেবিলের ঘরোয়া আড্ডায়। ব্র্যাকের হাত ধরে বাবা কত নতুন কিছু শিখলেন, জানলেন! এসব স্বীকার করতে তাঁর কোনো কার্পন্য নেই। তবে আমি মনে করি, দু’পক্ষের চিন্তাতেই যথেষ্ট মিল ছিল বলেই তিনি এতগুলো বছর ব্র্যাকে আছেন। ৭৫ মহাখালি তো তাঁর বাড়ি, শুধু চাকরির জায়গা নয়!

ব্র্যাকের ভাবনাগুলোকে আপন করে নিয়ে বাবা নিজের জীবনে প্রতিনিয়ত চর্চা করেছেন এবং আমাদেরকেও শিখিয়েছেন। আমি এজন্য গর্ববোধ করি যে, আজ আমিও একজন ব্র্যাককর্মী এবং বাবার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী!

ব্র্যাকে আমি কাজ করছি প্রায় দেড় বছর হতে চলল। প্রতিদিনই নতুন কিছু শিখছি। বাবার এই পুরস্কার প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে আমার শেখার গতিকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। বাবা তার কাজকে সবসময় খুবই উপভোগ করেন। আমি এখন এই বিষয়টিও উপলব্ধি করতে পারি, কাজের স্বীকৃতি কত বড়ো হতে পারে!

বাবার এই অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তি আমাকেও অনুপ্রাণিত করেছে। আমি আশা করি এই পুরস্কার প্রাপ্তি কেবল আমাকেই না বরং আমার মতো অন্য তরুণ ব্র্যাককর্মীদেরও প্রেরণা জোগাবে। বাবা হাসিমুখে কাজ করে যান। আমরা নতুন প্রজন্মও তাঁর মতো মানুষের জন্য কাজে আনন্দ খুঁজে নেব, ব্র্যাকের রূপকল্প বাস্তবায়নে আরও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করব!

বাবার কাছে ব্র্যাক হলো অসম্ভবকে সম্ভব করার এক মন্ত্র। যেকোনো ধরনের অসঙ্গতি কিংবা দুর্যোগ মুহূর্তে তাঁকে বলতে শুনেছি, ‘এই সমস্যার সমাধান কেবল ব্র্যাকের কাছেই আছে’। ব্র্যাকের মূল্যবোধের আড়ালে আছে অনেক সমস্যার সমাধান। বাবাকে কেবল ব্র্যাককর্মী নয়, বরং একজন দূত এবং শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে বিভিন্ন পারিবারিক বা সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্র্যাকের মন্ত্র প্রচার করতে দেখেছি। এও দেখেছি ব্র্যাক নিয়ে কেউ কোনো রকমের মন্তব্য করে তাঁর পাশ কাটিয়ে যাওয়া অসম্ভব। এটি হয়তো ব্র্যাকের প্রতি তাঁর গভীর মমত্ববোধ, আত্মবিশ্বাসেরই প্রতিফলন।

সবশেষে এটাই বলতে চাই যে, আমার বাবা এবং ব্র্যাকের সদাহাস্যময়, সবার প্রিয় কবীর ভাইয়ের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান গন্তব্য হলো একটাই, এবং তা হলো ‘ব্র্যাক’।

 

সম্পাদনা: তাজনীন সুলতানা এবং সুহৃদ স্বাগত

0 0 votes
ব্লগটি কেমন লেগেছে?