ব্র্যাককর্মীদের সাফল্য ও কর্মদক্ষতার স্বীকৃতি প্রদান এবং মূল্যবোধ ধারণ, লালন ও চর্চায় উৎসাহিত করতে ‘স্যার ফজলে হাসান আবেদ মূল্যবোধ পুরস্কার ২০২৫’ প্রদান করা হয়েছে। ব্র্যাকের ৫৩ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২৩শে মার্চ (রবিবার) মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে ব্র্যাক লার্নিং সেন্টারে (বিএলসি) আয়োজিত ব্র্যাক-ডে ২০২৫-এর অনুষ্ঠানে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়।
উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য পেশাদারিত্ব এবং সংস্থার মূল্যবোধসমূহের প্রতি সুষ্পষ্ট অঙ্গীকার জরুরি। কর্মীদের সেই অঙ্গীকারের স্বীকৃতি প্রদান করার উদ্দেশ্যে ২০১১ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি ব্র্যাকের প্রধান কার্যালয়ে সর্বপ্রথম কর্মীদের মধ্যে ব্র্যাক ব্র্যান্ড অ্যাওয়ার্ড ও মূল্যবোধ চর্চার ওপর পুরস্কার প্রদান করা হয়। এই অনুষ্ঠানে স্যার ফজলে হাসান আবেদ ঘোষণা করেন, ব্র্যাককর্মীদের প্রশংসনীয় কাজ, মূল্যবোধ চর্চা এবং প্রকৃত অঙ্গীকারের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রতিবছর মূল্যবোধ পুরস্কার প্রদান করা হবে। পুরস্কার প্রদানের উদ্দেশ্য হলো ব্র্যাককর্মীদের সাফল্য ও কর্মদক্ষতার স্বীকৃতি দেওয়া এবং কর্মীদেরকে মূল্যবোধগুলোর ধারণ, লালন ও মূল্যবোধ চর্চায় আরও উৎসাহিত করা।
ব্র্যাকের চারটি মূল্যবোধ যথা : সততা ও নিষ্ঠা, সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী মনোভাব, সার্বজনীনতা এবং কার্যকারিতা ক্যাটাগরিতেই মূল্যবোধ পুরস্কার প্রদান করা হয়।
২০২৫ সালে ব্র্যাক বাংলাদেশের মোট ৯ জন কর্মী স্যার ফজলে হাসান আবেদ মূল্যবোধ পুরস্কার পেয়েছেন। সংক্ষেপে তাদের পরিচয় জেনে নিই।

১২ বছরের কর্মজীবনে সততার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন মুহাম্মদ শামীম আজাদ। কাজের কোনো ভুল হলে তা এড়িয়ে না গিয়ে খুঁজে বের করে শিক্ষা নিয়েছেন, যাতে ভবিষ্যতে একই ভুল না হয়। সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করার পাশাপাশি সহকর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহমর্মিতা প্রদর্শন করে তিনি সকলের প্রিয় হয়ে উঠেছেন। কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের মূল্যবোধ বজায় রাখার পাশাপাশি তিনি সবসময় সহকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। পাশাপাশি নতুন কিছু করার চিন্তা ও তা বাস্তবায়নের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। সৃজনশীল ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার পাশাপাশি তিনি একজন দক্ষ টিম লিডার হিসেবেও নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেছেন।

সাবিনা ইয়াসমিন প্রতিনিয়ত সৃজনশীল চিন্তা ও কাজের মাধ্যমে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। তিনি জটিল সমস্যাগুলোর কার্যকর সমাধান খুঁজে বের করার পাশাপাশি নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সমাধানের পথ খুঁজে নেন। ব্র্যাকের কনস্ট্রাকশন, ডিজাইন ও মার্সেনটাইজিং ডিপার্টমেন্টে ২৬ বছরের কর্মজীবনে তিনি সততা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে চলেছেন, যা তাঁর পেশাদারিত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

কর্মজীবনের শুরু থেকেই ব্র্যাকের মূলবোধ ধারণ করে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন মোঃ আব্দুর রব। মেডিকেল টেকনোলজিস্ট হিসেবে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে গুরুতর যক্ষ্মারোগীদের চিকিৎসা সহায়তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। রোগীরা সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তিনি তাদের নিয়মিত খোঁজ-খবর নিয়ে পরামর্শ প্রদান করেছেন। এ ছাড় চট্টগ্রাম কারাগারে এমডিআর যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর পুরো কারাগারে যক্ষ্মা রোগী চিহ্নিত করার লক্ষ্যে তিনি প্রায় ৩শ জনের জিন-এক্সপার্ট ও এক্স-রে পরীক্ষা সম্পন্ন করেন, যার মধ্যে ১৭ জনের এমটিবি শনাক্ত হয়।

উদ্ভাবনী মনোভাব ও সাহসিকতার সঙ্গে নতুন উদ্যোগ গ্রহণে নুপুর আক্তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। নতুন কর্মপরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে গেছেন। একবার তার শাখার নারী কর্মীদের মোটরসাইকেল চালানো শেখানোর জন্য প্রশিক্ষক না পাওয়া গেলে তিনি নিজেই প্রশিক্ষণ দেওয়ার দায়িত্ব নেন। নিয়মিত কাজের বাইরে নিজ উদ্যোগে সংগঠনের সদস্যদের খোঁজ-খবর নেন এবং বিপদে-আপদে তাদের পাশে দাঁড়ান। তিনি সকলের প্রতি বৈষম্যহীন আচরণ করেন এবং অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করেন।

নীলুফা ইয়াসমিন সাহসের সঙ্গে যেকোনো নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। জেন্ডার মেইনস্ট্রিমিং কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি নারীর ক্ষমতায়ন, পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর সচেতনতা বৃদ্ধি এবং তাদেরকে মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করতে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন ব্র্যাকের অভ্যন্তরে এবং কমিউনিটি পর্যায়ে। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তিনি সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন ও সৃজনশীল কাজ করতে চেষ্টা করেন।

আলট্রা পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামের একজন কর্মী হিসেবে রুমা খাতুন শুধু দাপ্তরিক দায়িত্ব পালনের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি সবসময় সংগঠনের সদস্যদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাদের বিপদে-আপদে সহায়তা করেছেন। কোনো সদস্যের গরু হারিয়ে গেলে খুঁজে বের করা থেকে শুরু করে, ইউপি চেয়ারম্যান ও শিক্ষকদের সহযোগিতায় বাল্যবিবাহ বন্ধ করা, কারও জন্য টিউবওয়েলের ব্যবস্থা করা বা অসুস্থ গরু নিয়ে পশু হাসপাতালে ছুটে যাওয়ার মতো দায়িত্ব তিনি পালন করে থাকেন। কাজের প্রতি ভালোবাসা এবং সততা ও নিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি নিজ এলাকায় এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

সুফিয়া আক্তার সারাদিন গ্রামের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে সমাজের পিছিয়েপড়া মানুষদের খুঁজে বের করেন। তাদের সংগঠিত করে উপার্জনমূলক কাজের প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করেন। বঞ্চিত ও শোষিত নারীদের পাশে থেকে তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। কাজের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হলে সৃজনশীল উপায়ে তা মোকাবিলা করেন। পাশাপাশি জাতি, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সঙ্গে সমান আচরণ করেন এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বজায় রেখে নিজের দায়িত্ব পালন করেন।

সালমা জাহান তাদেরকেই খুঁজে বের করেন, যারা কিছু করতে চান কিন্তু সুযোগের অভাবে পিছিয়ে আছেন। তিনি প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দিয়ে তাদের কর্মসংস্থানে সহায়তা করে যাচ্ছেন। তার সহায়তায় অনেকেই এখন সফল টেইলর, কেঁচো চাষি কিংবা কৃষক হয়ে সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরিয়েছেন। কাজের প্রতি তার সততা, নিষ্ঠা এবং মানুষের প্রতি আন্তরিকতা তাকে সহকর্মীদের কাছে একজন প্রিয় মানুষ হিসেবে তুলে ধরেছে। বহু পরিবার তার সঠিক পরামর্শ ও সহযোগিতায় নতুন করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

মোঃ রেজওয়ানুল আলম দায়িত্বপালনে সবসময় সততা ও নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন। সফলতা হোক বা ব্যর্থতা—তিনি কখনও দায় এড়ানোর চেষ্টা করেন না। আড়ংয়ের আউটলেট ম্যানেজার হিসেবে প্রতিষ্ঠানের সুনাম বজায় রেখে আন্তরিকভাবে কাজ করে চলেছেন। যেকোনো সমস্যা মোকাবিলায় তিনি সবসময় কার্যকর সমাধানের পথ খোঁজেন। পাশাপাশি দক্ষ নেতৃত্ব তৈরিতেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। তার তত্ত্বাবধানে কাজ শিখে এখন অনেকেই আড়ংয়ের বিভিন্ন আউটলেট সফলভাবে পরিচালনা করছেন। সহকর্মীদের প্রতি তিনি সমান যত্নবান ও আন্তরিক। তিনি সকলের প্রিয়।



