‘স্যার ফজলে হাসান আবেদ মূল্যবোধ পুরস্কার ২০২৪’ যারা পেলেন

তারিখ: 25 মার্চ 2024

লেখক: ব্র্যাক

ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ বলেছিলেন, ‘একটি প্রতিষ্ঠানের সাফল্য নির্ভর করে তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রতি কর্মীদের নিষ্ঠা, মমতা ও কাজ সম্পন্ন করার দক্ষতার ওপর।’

ব্র্যাকের কর্মীরা দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কর্মীদের নিরলস প্রচেষ্টা তাদের মধ্যে এক ধরনের জীবনবোধ তৈরি করে দেয়। যার প্রতিফলনই হলো ব্র্যাক সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ।

উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য পেশাদারিত্ব এবং সংস্থার মূল্যবোধসমূহের প্রতি সুষ্পষ্ট অঙ্গীকার জরুরি। কর্মীদের সেই অঙ্গীকারের স্বীকৃতি প্রদান করার উদ্দেশ্যে ২রা ফেব্রুয়ারি ২০১১ তারিখে প্রধান কার্যালয়ে সর্বপ্রথম কর্মীদের মধ্যে ব্র্যাক ব্র্যান্ড অ্যাওয়ার্ড ও মূল্যবোধ চর্চার ওপর পুরস্কার প্রদান করা হয়। এই অনুষ্ঠানে স্যার ফজলে হাসান আবেদ ঘোষণা করেন যে, ব্র্যাককর্মীদের প্রশংসনীয় কাজ, মূল্যবোধ চর্চা এবং প্রকৃত অঙ্গীকারের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রতিবছর মূল্যবোধ পুরস্কার প্রদান করা হবে। পুরস্কার প্রদানের উদ্দেশ্য হলো ব্র্যাককর্মীদের সাফল্য ও কর্মদক্ষতার স্বীকৃতি দেওয়া এবং কর্মীদেরকে মূল্যবোধগুলোর ধারণ, লালন ও মূল্যবোধ চর্চায় আরও উৎসাহিত করা।

ব্র্যাকের চারটি মূল্যবোধ যথা : সততা ও নিষ্ঠা, সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী মনোভাব, সার্বজনীনতা এবং কার্যকারিতা ক্যাটাগরিতেই মূল্যবোধ পুরস্কার প্রদান করা হয়।

২০২৪ সালে ব্র্যাক ও ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের মোট ১৩ জন কর্মী স্যার ফজলে হাসান আবেদ মূল্যবোধ পুরস্কার পেয়েছেন। সংক্ষেপে তাদের পরিচয় জেনে নিই।


কর্মক্ষেত্রে এবং ব্যক্তিগত জীবনে সহকর্মীদের প্রতি সহযোগিতাপূর্ণ আচরণের জন্য ছোট-বড় সবার কাছে তিনি ‘বুবু’ নামে পরিচিত। তিনি যেমন সব সময় সাধারণ মানুষের প্রয়োজনে এগিয়ে এসেছেন, ঠিক তেমনি সহকর্মীদের নানা বিপদেও পাশে থেকেছেন। কর্মজীবেন অসংখ্য বাধা-বিপত্তিতেও হাল না ছেড়ে চরম ধৈর্য্যের পরিচয় দিয়েছেন এবং সফলতা অর্জনের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। পাশাপাশি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি সততার দৃষ্টান্ত  তৈরি করেছেন।



প্রতিকূল পরিস্থিতি বা ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সমস্যা সমাধানে তিনি এ পর্যন্ত বহুবার সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। নানা কর্মসূচি বাস্তবায়নে নিয়েছেন সময়োপযোগী সব সিদ্ধান্ত। ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনে জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে বৈষম্যহীন আচরণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য তিনি সকলের কাছ বিশেষভাবে পরিচিত। কর্মজীবনে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করার পাশাপাশি বিপদে-আপদেও সব সময় সদস্যদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। করোনা মহামারির সময়ে তিনি এলাকার লোকজন ও সদস্যদের সুরক্ষার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। এক সময় নিজেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। দীর্ঘ ১৯ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে তবেই ফিরেছেন।



মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতার আলোকে নিজস্ব চিন্তা-চেতনা কাজে লাগিয়ে তিনি নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বাস্তবায়ন ও কর্মসূচির অগ্রগতিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখে চলেছেন। একজন সৎ, পরিশ্রমী ও সফল কর্মী হিসেবে তিনি সকলের কাছে পরিচিতি। বাল্যবিবাহ ও যৌন হয়রানির মতো সামাজিক সমস্যা দূর করতে বিশেষ ভূমিকা রাখার পাশাপাশি সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত আচরণ ও প্রয়োজনীয় সহায়তা দিয়ে আসছেন।



মাঠ কার্যালয় ও প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশনা সমন্বয় করে ব্র্যাকের জেন্ডার মেইনস্ট্রিমিং উদ্যোগ এবং যে কোনো পদক্ষেপ নিষ্ঠার সঙ্গে বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছেন সারোয়ার হোসাইন। তিনি শুধু একজন সাপোর্টিভ সুপারভাইজার হিসেবেই নয়, কর্মস্থলে নারী কর্মীদের অংশগ্রহণ এবং নারীর ক্ষমতায়ন সম্পর্কিত সচেতনতা বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে প্রশংসিত হয়েছেন।



একজন শাখা ব্যবস্থাপক হিসেবে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন শাহনাজ পারভীন। সাহসী ও উদ্যমী নারী শাহানা পারভীন মোটরসাইকেল চালিয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে কাজ করেছেন। দক্ষতার সঙ্গে সময়োপযোগী ও নতুন কৌশল বাস্তায়ন এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে নারীদের আয়বর্ধক ও উৎপাদনমুখী কাজে যুক্ত হতে অনুপ্রাণিত করেন।



করোনা মহামারি বা ডেঙ্গুর বাড়বাড়ন্ত সময়ে তিনি নিজের জীবনের ঝুঁকির কথা না ভেবে মানুষের সেবায় ছুটে গিয়েছিলেন। নিজের ভেতর শুধু ব্র্যাককেই নয়, ধারণ করেছেন মানবতাকেও। জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের সেবায় বারবার তিনি এগিয়ে গেছেন।  আন্তরিকতা ও স্বভাবসুলভ আচরণে মুগ্ধ করেছেন তার কর্মএলাকার মানুষকে।



২০১৭ সালে কুড়িগ্রামের উলিপুরের হাটশাখায় যোগদানের পর তিনি নিজ উদ্যোগে একের পর এক গ্রাম সংগঠন তৈরি করে ওই শাখার সুনাম বৃদ্ধি করেছেন। সেইসঙ্গে মহাজনী ঋণের ফাঁদ থেকে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে মুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। ব্র্যাকের মূল্যবোধ চর্চা ও সংবেদনশীল আচরণের মাধ্যমে হাটশাখা অফিস ও গ্রাম সংগঠনে তিনি হয়ে উঠেছেন এক অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব।



আন্তরিক প্রচেষ্টা ও ব্র্যাক মূল্যবোধের ওপর আস্থা রেখে দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে সততার সঙ্গে কাজ করে চলেছেন স্বপ্না মণ্ডল। সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে দিকনির্দেশনা এবং কর্মী পরিচালনায় তার দক্ষতা বয়ে এনেছে ইতিবাচক পরিবর্তন। তিনি বুদ্ধিমত্তা ও সাহসিকতার সঙ্গে নানাবিধ অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন। কর্মসূচির লক্ষ্য অর্জনে সব সময় তিনি কর্মীদের পাশে থেকে উৎসাহ দেন।



বাংলাদেশের দরিদ্র কৃষকদের নানাবিধ সমস্যা সমাধান, কর্মসংস্থান তৈরি ও কৃষি উন্নয়নে ব্র্যাকের যে প্রচেষ্টা, তাতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন আজিজুল হক। সকল কাজে সততা ও স্বচ্ছতা এবং ঝুঁকির মাত্রা বিবেচনা করে বিকল্প উদ্যোগ গ্রহণে সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। সময়োপযোগী ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে তিনি ব্র্যাক এন্টারপ্রাইজের সাফল্য অর্জনে  বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন।



ব্র্যাককর্মী ও সদস্যদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণের জন্য তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। তানজানিয়ার শিক্ষাব্যবস্থায় ডিজিটাল স্কিল ও কোডিংয়ের মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে নতুন পাঠ্যসূচি তৈরি করতে তিনি সরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন। এ ছাড়া দেশটির তরুণ প্রজন্মকে প্রযুক্তিজ্ঞানে সমৃদ্ধ করতে এডুকেশন অথরিটি, ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন ও মিনিস্ট্রি অব এডুকেশনের সঙ্গে নতুন শিক্ষা কারিকুলাম তৈরিতেও নিরলসভাবে কাজ করেছেন। পাশাপাশি এক হাজারেরও বেশি মানুষকে প্রযুক্তি শিক্ষা পেতে সহায়তা করেছেন। এ ছাড়া লেমি লুসিয়ান Technology Entrepreneurship Accelerator Program (TEAP) নামে তরুণদের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছেন, যেখানে তরুণরা তাদের টেকনোলজি বিসনেজ আইডিয়াগুলো তুলে ধরতে পারে।



‘দলগতভাবে কাজ করলে সাফল্য মেলে’ এ কথায় বিশ্বাস রেখে জ্যাকলিন বায়ামবা কোর ব্যাংকিং সিস্টেমকে (টি২৪) নতুনভাবে রূপান্তরে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছেন। পাশাপাশি সর্বদা ব্র্যাকের মূল্যবোধ চর্চার মাধ্যমে জ্যাকলিন হয়ে উঠেছেন সকলের মধ্যে অনন্য। বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে তিনি গড়ে তুলেছেন আন্তরিক কর্মপরিবেশ। যে কোনো পরিবর্তনকে সাদরে গ্রহণ এবং প্রতিনিয়ত শেখার মনোভাব নিয়ে কাজ করেন জ্যাকলিন।



দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা পরিবর্তনে সাবারই অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে—এই চেতনা লালন করে তিনি সমাজের সকল মানুষকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। দারুস সালামে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় ব্র্যাকের প্রতি অসন্তুষ্টি তৈরি হলে এশিয়া বোটিয়া নিজ উদ্যোগে ঝুঁকি নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কাজ করেছেন। এশিয়া বোটিয়ার নানা প্রচেষ্টার ফলে ওই এলাকায় ব্র্যাকের ভাবমূর্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া কর্মসূচি বাস্তবায়নে তিনি নতুন নতুন উদ্ভাবনী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।



ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে ব্র্যাকের মূল্যবোধ অনুশীলনের মাধ্যমে সকলের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেন মারিয়া জার চি লিন। তার কাছে ছোট-বড় কাজের কোনো ভেদাভেদ নেই। নতুন কিছু শেখার ব্যাপারে অদম্য আগ্রহী মারিয়া সাম্প্রতিককালে মিয়ানমারের গ্রামাঞ্চলগুলোতে কৃষি ঋণের পাইলট প্রকল্প চালু করেছেন, যা ইতোমধ্যে সফল পাইলট প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। কাজের প্রয়োজনে নিয়েছেন নানা উদ্ভাবনী উদ্যোগ। অনেক সময়ই ব্যর্থ হয়েছেন, কিন্তু সেটাকেই শিক্ষা হিসেবে গ্রহণ করে এগিয়ে চলেছেন।

3 2 votes
ব্লগটি কেমন লেগেছে?