স্বাধীনতার প্রথম পাঁচ বছরে বাংলাদেশ ছিল বহুমুখী সমস্যায় জর্জরিত। একদিকে অভ্যন্তরীণ সম্পদের ঘাটতি, অন্যদিকে উন্নয়ন কাজে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা। এর মধ্যে ১৯৭৩ সালের ৩১শে ডিসেম্বর ইউএনআরওডি (ইউনাইটেড নেশন রিলিফ অপারেশন টিম ইন ঢাকা) হঠাৎ তাদের ত্রাণ কর্মসূচি বন্ধ ঘোষণা করে। এতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকটের বিষয়টি আরও প্রকট হয়। পরবর্তী কয়েক বছর খাদ্য ঘাটতি, মুদ্রাস্ফীতি, আকস্মিক বন্যা, জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা কিছুতে জর্জরিত হয়ে ওঠে জনজীবন। ১৯৭৪ সালে দেশের বিভিন্ন স্থানে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। সংকট মোকাবিলায় এ সময় যে ক’জন ব্যক্তি এগিয়ে আসেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ।
একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় স্যার ফজলে হাসান আবেদ ছিলেন ৩৫ বছরের তরুণ। শেল অয়েল কোম্পানির হেড অব ফাইন্যান্স পদে কাজ করছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিল মাসে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলে যান লন্ডনে। সেখানে বন্ধু ও সহকর্মীরা মিলে ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ ও ‘হেল্প বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন। ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ একাত্তরে গণহত্যার বিষয়টি আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তুলে ধরে। ‘হেল্প বাংলাদেশ’ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তহবিল সংগ্রহের করে। এই কাজে নেতৃত্ব দেন আবেদ।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পর, ’৭২-এর জানুয়ারির শেষদিকে দেশে ফিরতে শুরু করে ভারতে আশ্রয় নেওয়া প্রায় দশ মিলিয়ন শরণার্থী। ইউএনএইচসিআর প্রকাশিত The State of The World’s Refugees 2000-এর সূত্রমতে এ সময় প্রায় ৬০ লাখ শরণার্থী দেশে ফিরে আসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যা ছিল বিশ্বের সবচাইতে বড় প্রত্যাবাসন কর্মসূচি। দেশ পুনর্গঠনের পাশাপাশি শরণার্থীদের পুনর্বাসনও তাই হয়ে ওঠে রাষ্ট্রের মূল অ্যাজেন্ডা।
১৯৭২ সালের ১৭ই জানুয়ারি লন্ডনের চ্যাপ্টার গুছিয়ে দেশে ফেরেন আবেদ। সিলেটের হাওর ঘেরা দুর্গম শাল্লায় প্রতিষ্ঠা করেন ব্র্যাক। শাল্লা ও দিরাই অঞ্চলে ভারত-প্রত্যাগত নিঃস্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে ত্রাণ কর্মসূচি পরিচালনা ছিল এর প্রাথমিক লক্ষ্য। বন্ধু ভিকার চৌধুরীর চিঠিতে শাল্লা সম্পর্কে আগেই জেনেছিলেন আবেদ। সিলেটের হিন্দুপ্রধান এই অঞ্চলটিকে গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। লুটপাট করে তাদের ধনসম্পদ ও ঘরবাড়ি। দেশে ফিরে কাজ শুরু করতে প্রয়োজন টাকার, এই ভেবে ক্যামডেন হাউজে আবেদ তাঁর ফ্ল্যাটের শেয়ার বিক্রি করে দেন ৮ হাজার পাউন্ডে। প্রিয় লেখক শেকসপিয়র ও বার্নাড শ’র কিছু বই ছাড়া ফেলে আসেন আর সব।
বিধ্বস্ত দেশ, মানুষের মনে তখনও যুদ্ধের ক্ষত। যুদ্ধে আবেদ হারিয়েছেন তাঁর মেন্টর, ও ছোট চাচা (শহীদ বুদ্ধিজীবী) সায়ীদুল হাসানকে। ফেব্রুয়ারি মাসে শাল্লার পরিস্থিতি নিজ চোখে দেখার সিদ্ধান্ত নেন। ঢাকা থেকে শাল্লার সরাসরি কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই। প্রথমে যান দিরাই, এরপর স্থানীয় কয়েকজন তরুণকে সঙ্গে নিয়ে ১৭ মাইল পায়ে হেঁটে পৌঁছান শাল্লায়। সেই দীর্ঘ ও কষ্টকর যাত্রায় তাঁর সঙ্গী ছিলেন গুণেন্দু রায়, রামানন্দ রায়, গীষ্পতি রায়সহ কিছু স্থানীয় তরুণ। এদের অনেকেই সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। শাল্লায় পৌঁছে আবেদ স্থানীয়দের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেন। ক্ষয়-ক্ষতি যা ধারণা করেছিলেন তার থেকেও ছিল অনেক বেশি।
সে-ই রাতে একটা দোকানের মাচায় ঘুমিয়েছিলেন ৩৬ বছরের আবেদ। রাতে প্রচণ্ড ঝড়ে ভিজে একাকার। তাঁর জীবনে দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন আনে এই অভিজ্ঞতা। অনুভব করেন, শুধুমাত্র অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রির টাকা আর মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘হেলপ বাংলাদেশ’-এর অবশিষ্ট ২৫ হাজার ভারতীয় রূপি দিয়ে এই ক্ষয়ক্ষতি সামলানো সম্ভব না। দরকার আরও সুচারু পরিকল্পনা, বড় অংকের তহবিল। পেশায় অ্যাকাউনটেন্ট হলেও আবেদের দৃষ্টিভঙ্গী ছিল একজন সমাজবিজ্ঞানীর মতো। শাল্লায় কিছু তরুণকে নিয়োগ দেন জরিপের কাজে। তরুণদের ওপর আবেদের ছিল অগাধ আস্থা। তরুণরা নোটবই ও কলম হাতে ঘুরে ঘুরে কার কী ক্ষয়-ক্ষতি তা তুলে আনে। জরিপের প্রফর্মা তৈরি করেন আবেদ নিজেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু তরুণ পরিসংখ্যানবিদ ও শিক্ষক জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণ করেন।

ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার উদ্দেশ্যে শাল্লায় জরিপ কাজ
স্থানীয় তরুণ কর্মীরা প্রাথমিকভাবে ‘ত্রাণ সংঘ’ নামেই পুনর্বাসনের কাজ পরিচালনা করছিলI আবেদ এর নাম পালটে রাখেন ‘বাংলাদেশ পুনর্বাসন সহায়ক কমিটি’, সংক্ষেপে ব্র্যাক। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দাঁড় করাতে তখন প্রয়োজন পড়ে একটি পরিচালনা পর্ষদের। বাংলাদেশ বিনির্মাণের অনুরূপ আদর্শ ধারণ করা ব্যক্তিদের ব্র্যাকের বোর্ড সদস্য হতে অনুরোধ করেন আবেদ। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে কবি ও নারীবাদী কর্মী বেগম সুফিয়া কামাল যোগ দেন বোর্ডের চেয়ারপারসন হিসেবে। আরও যুক্ত হন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। ৯৫, মতিঝিলে ভিকার চৌধুরীর ল’ চেম্বারে খোলা হয় ব্র্যাকের অস্থায়ী অফিস।
অচিরেই মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে বেড়ে ওঠা একটা সচেতন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হন আবেদ। সে সময় দেশ পুনর্গঠনে কাজ করতে চাওয়া উদ্যমী তরুণদের কাছে ব্র্যাক হয়ে ওঠে একটি যুতসই প্ল্যাটফর্ম। পরবর্তীতে এদের অনেকেই দীর্ঘ সময় কাটান আবেদের সান্নিধ্যে। ব্র্যাকের মাধ্যমে অবদান রাখেন বাংলাদেশের নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে।
বাংলাদেশের এই সংকটে অক্সফাম চাচ্ছিল বড় অংকের তহবিল দিতে। কিন্তু এ নিয়ে সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ের সঙ্গে স্থানীয় কার্যালয়ের মতবিরোধ চলছিল। প্রধান কার্যালয় চাচ্ছিল বড় কোনো প্রতিষ্ঠানকে তহবিল দিতে। ‘ভিশন আছে এমন বাংলাদেশি তরুণদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ’ করতে চাচ্ছিলেন অক্সফামের ফিল্ড ডিরেক্টর রেমন্ড কুনোয়ার। আবেদ শাল্লার জরিপের ভিত্তিতে অক্সফামে একটা খসড়া পরিকল্পনা জমা দেন। মুগ্ধ হন রেমন্ড। যে ভিশনারি তরুণের খোঁজ করছিলেন, আবেদের মধ্যে তিনি সেটা দেখতে পান। অক্সফামের ওভারসিস এইড ডিরেক্টর কেন বেনেথও তথ্য-উপাত্তভিত্তিক আবেদের পরিকল্পনাটিকে পছন্দ করেন। সেইসঙ্গে যেখানে সহজে ত্রাণ ও সহযোগিতা পৌঁছায় না এমন দুর্গম জায়গা বেছে নেওয়ার বিষয়টিও তাঁর ভালো লাগে। অক্সফাম ব্র্যাককে ৪ লাখ ৩০ হাজার ডলারের অনুদান দেয়। ব্র্যাক ছাড়াও আরও দু’টি প্রকল্প—‘গণমিলন’ ও ‘বাংলাদেশ সরকার’, অক্সফামের অনুদান পায়।
তহবিল পেয়ে সুচারু পরিকল্পনায় শাল্লাতে বড় আকারে কাজ শুরু করেন আবেদ। পার্শ্ববর্তী এলাকা মার্কুলিকে বেইজ ক্যাম্প করে ৯ মাস (’৭২-এর ফেব্রুয়ারি-অক্টোবর) এই প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ চলে। ফান্ডের সর্বোচ্চ ব্যবহারের লক্ষ্যে সব রকমের পদক্ষেপ নেন তিনি। আসামের রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে কম দামে বাঁশ কিনে কুশিয়ারা নদী দিয়ে ভাসিয়ে দেশে আনেন। পাশাপাশি সরকার দেয় ২০০ টন করোগেটেড আয়রন শিট। গোটা জনগোষ্ঠীকে আবেদ ভাগ করেন ৪টি ভাগে। এভাবে ভাগ করার মাধ্যমে, প্রাথমিকভাবে নির্ধারিত ৬ হাজার ৫০০টি ঘর তৈরির লক্ষ্য অতিক্রম করে ১০ হাজার ২০০টি ঘর তৈরি করে ব্র্যাক এবং ৩ হাজার ৯০০টি পরিবারকে বাড়ি মেরামতের জন্য বাঁশ ও টিন দেয়। মোট ১৪ হাজার ১০০টি পরিবারকে সাহায্য করার পরও ১৬ হাজার ৫০০ পাউন্ড রয়ে যায়। অক্সফামের কাছে তা ফেরত দেওয়ার প্রস্তাব দেন আবেদ। অক্সফামের কাছে ঘটনাটি ছিল অত্যন্ত বিরল। সংস্থাটি আবেদকে আরেকটি প্রস্তাবনা লেখার অনুরোধ করে। শুরু হয় শাল্লা প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়। শাল্লা হয়ে ওঠে ব্র্যাকের ‘লার্নিং ল্যাবরেটরি’।

শাল্লায় ব্র্যাকের প্রথম অফিস
শুরু থেকেই ব্র্যাককে একটা ‘লার্নিং অর্গানাইজেশন’ হিসেবে গড়ে তুলছিলেন আবেদ। স্থানীয় জনগোষ্ঠী থেকে পাওয়া নানা শিক্ষাকে তিনি পরবর্তীতে কাজে লাগান। অনুভব করেন, শুধু ত্রাণ দিয়ে মানুষের স্থায়ী উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব না। তাই গুরুত্ব দেন জনগণের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন প্রচেষ্টায়। এর প্রেক্ষিতে ব্র্যাকের নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘বাংলাদেশ রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট কমিটি’। শাল্লায় কৃষি, মাছচাষ, ব্যবহারিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, কারিগরি প্রশিক্ষণ, কমিউনিটি সেন্টার ডেভেলপমেন্ট (যা ‘গণকেন্দ্র’ নামে পরিচিত ছিল)—এই ৮টি ক্ষেত্রে কাজ করে ব্র্যাক। গণকেন্দ্রগুলো গড়ে ওঠে গ্রামের উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে। সেখানে স্থানীয় মানুষজন নানা বিষয়ে ভাবনা বিনিময়ের সুযোগ পেতেন। তাছাড়া স্থানীয় জেলেদের জাল ও সুতা কেনার জন্য টাকা দেয় ব্র্যাক। এর মাধ্যমে অনানুষ্ঠানিকভাবে ব্র্যাকে ‘ক্ষুদ্র অর্থায়ন’ শুরু হয়। যদিও বাংলাদেশে তখনও ক্ষুদ্র অর্থায়ন’ ধারণাটি প্রচলিত ছিল না।
এ সময় আবেদ উন্নয়নক্ষেত্রে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। শাল্লার দ্বিতীয় পর্যায় কুমিল্লার বার্ড মডেল দিয়ে শুরু করলেও প্রকল্প শেষে অনুভব করেন, সবচাইতে কম উপকৃত হয়েছে দরিদ্র জনগোষ্ঠী। গ্রামের সব মানুষ এক রকম নয়, তাদের মধ্যে অনেক ধরনের স্বার্থগত পার্থক্য আছে। এই উপলদ্ধি থেকে ব্র্যাকের উন্নয়ন কৌশলে পরিবর্তন আনেন আবেদ। ‘কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট’ অ্যাপ্রোচ থেকে চলে যান ‘কনসিয়েনটাইজেশন’ অ্যাপ্রোচে। শুধুমাত্র ভূমিহীনদেরকে টার্গেট করে কর্মসূচির পরিকল্পনা করেন।
‘কনসিয়েনটাইজেশন’ ধারণাটির জনক ব্রাজিলিয়ান শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক পাওলো ফ্রেইরি। তবে ধারণাটিকে আবেদ দক্ষিণের উন্নয়ন ধারণার সঙ্গে যুক্ত করে নতুন এক রূপ দেন। এর লক্ষ্য ছিল দরিদ্র আর শোষিত মানুষেরা নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করবে। গোষ্ঠীগুলোর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তি এমনভাবে সংগঠিত হবে যাতে তাদের ব্র্যাকের ওপর নির্ভরতা কমে যায় এবং কার্যক্রমগুলো আরও টেকসই হয়।

বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম
ধীরে ধীরে শাল্লা ছাড়িয়ে রৌমারি, জামালপুর ও মানিকগঞ্জে ব্র্যাকের কাজের বিস্তৃতি ঘটান আবেদ। দুর্ভিক্ষপীড়িত রৌমারিতে শিশু মৃত্যু ঠেকানোর পদক্ষেপ হিসেবে অক্সফামের অর্থায়নে শূন্য থেকে ১৫ বছর বয়সের ৩৫ হাজার ছেলেমেয়ের জন্য দুই বেলা খিচুড়ির ব্যবস্থা করেন। অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের জন্য গড়ে তোলেন পুষ্টিকেন্দ্র। রৌমারির কাজের অভিজ্ঞতা থেকে আবেদ নারীদের শক্তির জায়গাটি উপলদ্ধি করেন। সব চ্যালেঞ্জের মধ্যেও গ্রামীণ নারীরা তাদের শিশুদের জন্য খাবার নিশ্চিত করতে অটল ছিলেন। তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে সমাজের উন্নয়নের জন্য নারীদের নেতৃত্ব অপরিহার্য। পরবর্তীতে, ব্র্যাকের সব কাজে এর প্রতিফলন ঘটান আবেদ। পাশাপাশি গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোতে স্থানীয় প্রভাবশালীদের অবস্থান সম্পর্কে নতুন অন্তর্দৃষ্টিও পান। উন্নয়নের কাজগুলোকে নিঙড়ে বোঝা ও মূল্যায়নের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন একটি নিজস্ব গবেষণা ইউনিট।
চুয়াত্তরের বন্যায় দারুণ খাদ্য সংকটে পড়ে জামালপুর। ইউনিসেফের অনুরোধে আবেদ ভিক্ষাবৃত্তিতে যুক্ত থাকা সেখানকার ৮৪০ জন নারীকে নিয়ে চালু করেন ব্যবহারিক শিক্ষার কর্মসূচি। সচেতনতার পাশাপাশি, পরিবার পরিকল্পনা, সঞ্চয় ও সমবায়ভিত্তিক কর্মকাণ্ড, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, হাঁসমুরগি ও গবাদিপশু পালন, চাষাবাদসহ নানা বিষয়ে তাদের জ্ঞান ও দক্ষতাকে বাড়িয়ে তোলার উদ্যোগ নেন। নারীদের আর্থিকভাবে সাবলম্বী করতে যুক্ত করেন ধানভানা, কাঁথাসেলাই, তেলভাঙা, সেরিকালচারসহ নানা কাজে। দাতাগোষ্ঠী প্রভাবিত উন্নয়নের প্রথাগত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে এই নারীরাই এক সময় একটি কর্মসূচি প্রণয়ন করে। যা আরও বেশি অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতির রূপরেখা দেয়।
নানা ক্ষেত্রে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে আবেদ অনুভব করেন, দারিদ্র্য ও অসাম্যের কারণগুলো জটিল; পরস্পর নিবিড়ভাবে জড়িত। ফলে এর সমাধানও হতে হবে বহুমাত্রিক। এ কারণে শাল্লা, রৌমারি ও জামালপুরের শিক্ষা নিয়ে উন্নয়নের একটি সমন্বিত কৌশল গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। মানিকগঞ্জকে নির্বাচন করেন কার্যক্ষেত্র হিসেবে। স্বাস্থ্য, উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা, কৃষি ও আয়বর্ধক কাজগুলোকে একত্রিত করে সেখানকার মানুষকে বহুমুখী কাজের সঙ্গে যুক্ত করেন। পরবর্তীতে ব্র্যাকের সব কর্মকাণ্ড উন্নয়নের এই সমন্বিত ধারণার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে। নারীদের হস্তশিল্প দক্ষতাকে বাজারের সঙ্গে যুক্ত করার ধারণা থেকে শুরু হয় আড়ং ও আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন। বর্তমান ব্র্যাকের অনেক কর্মসূচি ও সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজের গোড়াপত্তন হয় মানিকগঞ্জে। জায়গাটি তাই ব্র্যাকের ‘আঁতুড়ঘর’ বা ‘টেস্টিং গ্রাউন্ড’ নামেও পরিচিত।

আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশনের কারুশিল্পীরা
স্বাধীনতার প্রথম পাঁচ বছরের টালমাটাল সময়ে আবেদ রাষ্ট্রের পুনর্গঠনে শক্তিশালী ভূমিকা রাখেন। তারুণ্যের বিপুল শক্তি ও সম্ভাবনাকে তিনি উদ্বুদ্ধ করেন। একজন সমাজবিজ্ঞানীর চোখ দিয়ে মোকাবিলা করেন রাষ্ট্রের বিবিধ সমস্যাকে। আবেদের এই উদ্যোগ শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়েও উন্নয়ন কাজের ক্ষেত্রে ‘দক্ষিণ গোলার্ধের উন্নয়ন মডেল’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তারুণ্যের শক্তি, উদ্ভাবনী দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানুষের প্রতি অটুট বিশ্বাসই ছিল এই ঐতিহাসিক পথচলার ভিত্তি। গত পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ ও বিশ্বের মানুষের যেকোনো দুর্যোগ ও সংকটে পাশে আছে ব্র্যাক। আবেদ প্রমাণ করেছেন, সংকট যত গভীরই হোক না কেন, ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা এবং সুদূরপ্রসারী ভিশনের মাধ্যমে তা অতিক্রম করা সম্ভব। তাঁর দেখানো এই পথ হতে পারে আগামির পৃথিবী বিনির্মাণের পাথেয়।



