স্বপ্নসারথিদের মেলা

তারিখ: 20 জুল. 2025

লেখক: জয়শ্রী সরকার

কিশোরীরা যেন প্রজাপতির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। একজন কাগজ কাটছে তো অন্যজন আঠা লাগিয়ে তা প্যান্ডেলের চারদিকে সেঁটে দিচ্ছে। কেউ বেলুন ফুলাচ্ছে তো কেউ সেগুলো বেঁধে ঝুলিয়ে রাখছে। আবার কেউ রঙিন কাগজ কেটে ফুল পাখি, ঘর, আসবাব বানানোর কাজে ব্যস্ত। সুপারি গাছের পাতা দিয়ে বানানো হচ্ছে ঘড়ি, চশমা। মাটি দিয়ে তৈরি হচ্ছে গাছ, খরগোশ, ঘোড়া, পুতুল কত কী! চারিদিকে একটা হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার।

স্বপ্নসারথিদের তৈরি কারুপণ্য (মানিকগঞ্জ)

এত কিছুর মধ্যে রুখব এবার সবাই মিলে, নির্যাতন আর বাল্যবিয়ে লেখাটি নজর কাড়ল। আসলে এখানে একেক জন একেক রকম কাজ করছে কিন্তু সবমিলিয়ে সবাই বলছে সেশন থেকে নিজেদের শিখতে-জানতে পারার কথা।

স্বপ্নের মেলায় এক দল কিশোরী (সিরাজগঞ্জ)

গত ২৩ জুন মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায় আমি গিয়েছিলাম। পৌষমেলা, বৈশাখি মেলা কত মেলা দেখেছি, এবার দেখলাম স্বপ্নের মেলা

কথার পর কথা চলে, গান হয়, নাচ, ছড়া হয় আর আমি প্রাণভরে দেখি। আকাশে হঠাৎ আসা ঝড়ো বৃষ্টি বাতাসেও ওরা ক্লান্ত হয় না। ওদের খোলা মনের হাসি উঠানে যেন ঝমঝমিয়ে বাজছে।

স্বপ্নের মেলার আয়োজনে আছে একদল ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সী কিশোরী মেয়ে। দুই বছর ধরে তারা ব্র্যাকের স্বপ্নসারথি উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত থেকে জীবন দক্ষতামূলক সেশনে অংশগ্রহণ করেছে। চব্বিশতম সেশনে তাদের তেইশ মাসের শেখা ও কাজের রিভিশন ও এক্সিবিশন হচ্ছে। এখানে অভিভাবকরাও এসেছেন। ছোটরাও গুটি গুটি পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বড়দের কেউ কেউ কাছাকাছি বসে, কেউ দূরের বারান্দায় বসে আছেন। কিন্তু তাদের সবার দৃষ্টি ঠিক প্যান্ডেলের দিকেই। ঘণ্টা দেড়েক চলল স্বপ্নসারথিদের আয়োজন। মেলায় এসে সেই আনন্দের স্রোতেই ওরা ওদের দুই বছরে যা শিখেছে তার গল্প শোনায়। এসময় কিশোরীরা বলে, বড় হয়ে কী হতে চায়। বলে, কীভাবে তারা পেতে পারে স্বপ্নের দেখা।

রঙিন কাগজে নিজের স্বপ্নের কথা লিখেছে রুমানা (হবিগঞ্জ)

আচ্ছা, প্রতি মাসে বাংলাদেশে কতজন মেয়ের বাল্যবিয়ে হয়, সংখ্যাটা কেউ বলতে পারবেন?  

বাংলাদেশে ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ৫১.৪ শতাংশেরই  বিয়ে হয়েছে ১৮ বছর হওয়ার আগে। ঘুম থেকে রাত অবধি কুটাবাছা, রান্নাবান্না, ঘরদোর মোছা, কাপড় ধোওয়া সব করতে হয়। ভুলে যেতে হয় খেলাধুলো, দুরন্ত বেগে অজানার পথে ছুটে চলা রঙিন স্বপ্নগুলোকে। যখন-তখন মা-বাবার কাছে বায়না, অভিযোগ-অভিমান-আবদার এসবের আর সময় কোথায়! তারপর, শিশুর কোলে আসে নতুন শিশু। সে হয়ে ওঠে মা। সেই সংখ্যা এক…দুই…তিন… কত হবে আমরা জানি না। ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী এক হাজার মেয়ের মধ্যে ৭১  জন এক বা একাধিক সন্তানের মা।

দুই কাঁধে বোঝা নিতে নিতে তারা বড় হওয়ার আগেই কুঁজো বুড়ি হয়ে যায়। বয়সে সে কিশোরী হলেও সংসার মনে করে সে একজন পূর্ণবয়স্ক নারীর মতো দায়িত্ব পালন করবে, আচরণ করবে। কিন্তু সে তো আসলে ছোট, সে পারে না। আর এর মাশুল দিতে গিয়ে কতজনকে যে নির্যাতনের শিকার হতে হয়!

আমাদের এই দেশেই আবার ৩১ জেলার ২৪০টি উপজেলায় গ্রামভিত্তিক ২৩৪০টি স্বপ্নসারথি দলের প্রায় ৬০ হাজার মেয়ে এই মেলা করছে। সত্যিই তা বিস্ময় এবং মহা আনন্দের।

আমি স্বপ্নসারথিদের কথা খুব মন দিয়ে শুনি। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে। তার আগে গড়ে তুলতে হবে নিজেকে। তারা যেন তা-ই করছে। তাদের দৃঢ় মনোবল আমার মনে আশা জাগায়।

স্বপ্নসারথি মুন্নী বলে, “যহন বিয়া প্রায় ঠিক অইয়া যায় তহন মায়রে কই, আমি বিয়া করুম না। আমি পড়বার চাই। ওরা যহন মানছাল না তহন ব্র্যাকের পলি আন্টিরে কই। মায় অভিভাবক মিটিং-এ আইলে সে মায়েরে মেলা সময় ধইরা বুঝাইয়া কয়। তারপর মায়ের মন বদলায়। বাড়ি যাইয়া বাবারে বুঝাইয়া কয়। আমার বিয়া থাইম্যা যায়। যদি বিয়া দিয়া দিত তাইলে এহন আমি এইচএসসি পরীক্ষা দিবার পারতাম না।

অর্পিতা বলে, “স্বপ্নসারথি দলে আইসা স্পষ্ট কইরা মনের কথা কইবার শিখছি। আমারে ছেলেপক্ষ দেইখ্যা পছন্দ করছাল, কিন্তু বাবারে কইছি এহন কিছুতে বিয়া করতাম না। তারপরই আমার বিয়া বন্ধ অইলো।

বাধা পেরিয়ে স্বপ্নগুলো মেলুক ডানা (নেত্রকোনা)

ওদের দেখি আর ভাবি, না জানি কত শত কন্যাশিশুর বিয়ে আজ হয়ে যাচ্ছে! কতশত মেয়েকে বাধ্য হয়ে সংসারের ভার, নিপীড়ন সইতে হচ্ছে। ওদের কাছে যদি এই স্বপ্নের মেলাকে নিয়ে যাওয়া যেত!

 

জয়শ্রী সরকার ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন ও আইনি সুরক্ষা কর্মসূচিতে প্রোগ্রাম ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন।

5 1 vote
ব্লগটি কেমন লেগেছে?