তারিখটা ছিল ২রা আগস্ট ১৯৯২। সকাল দশটার দিকে একটি চিঠি নিয়ে হাজির হয়েছিলাম মহাখালীস্থ ৬৬ নম্বরে তৎকালীন ব্র্যাক-এর প্রধান কার্যালয়ে। উদ্দেশ্য ছিল শুধুই চিঠি পৌঁছে দেওয়া। রিসেপশনে সবকিছু জানালে আমাকে পাঠানো হলো তৃতীয় তলায়।
ওপরে উঠে দেখি, পশ্চিম কোণার একটি দরজার সামনে লম্বা সেক্রেটারিয়েট টেবিলে একজন নারী কাজ করছেন। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল ভারী, দরাজ আর আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। তিনি টেবিলে বসে নির্দেশনা প্রদান করছেন, আর কেউ না কেউ ছুটে এসে দায়িত্ব পালন করছে। পরে জেনেছিলাম তাঁর নাম নাজমা হাফিজ এবং তিনি ফজলে হাসান আবেদের সেক্রেটারি।
সেই নাজমা আপা হঠাৎই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কার কাছে যাবে?’ আমি কিছুটা সংকোচ নিয়ে বললাম, ‘ফজলে হাসান আবেদকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটি খাম এনেছি।’ তিনি বললেন, ‘দেখি খামটা।’ খাম হাতে নিয়ে বললেন, ‘বসো, ইডি (ED) বাইরের কল-এ আছেন। শেষ হলে ডাকবেন।’ তাৎক্ষণিকভাবে এক অজানা স্বস্তি অনুভব করেছিলাম।
কিছুক্ষণ পর তাঁর টেলিফোন বেজে উঠল। তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক ফজলে হাসান আবেদের কক্ষে। কক্ষে ঢোকার পর তাঁর টেবিলের সামনে থাকা একটি চেয়ারে ফজলে আবেদ আমাকে বসতে বললেন। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, আমার কল্পনায় তাঁর যে গাম্ভীর্যপূর্ণ চিত্র আঁকা ছিল, বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। সাধারণ একটি কক্ষ, সাদামাটা চেয়ার-টেবিল এবং তিনিও সাদামাটা পোশাকে! অফ হোয়াইট রঙের ভিন্নধর্মী একটি শার্ট পরে আছেন। পরে তাঁকে বারবার এমন পোশাকেই দেখেছি।
পরিচয়ের পর তিনি আমার কাজের অভিজ্ঞতা জানতে চাইলেন। বললাম, আমি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে সায়ীদ স্যারের কাছাকাছি থেকে কাজ করেছি। বিশেষ করে স্কুল-কলেজে বইমেলার আয়োজন ও বাস্তবায়নের দায়িত্বে ছিলাম। শুনে তিনি বললেন, ‘ব্র্যাকের যেসব বই আছে, সেগুলো নিয়ে স্কুল-কলেজে ওই ধরনের বইমেলা করা যায় কি?’ আমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললাম, ‘আমি পারব।’
এখানে বলে রাখা ভালো, চিঠি পড়ে তিনি ইতিমধ্যেই আমাকে একজন সম্ভাব্য চাকরি প্রার্থী হিসেবে বিবেচনায় নিয়েছিলেন এবং আমার সঙ্গে তাঁর কথোপকথন ছিল এক ধরনের ইন্টারভিউ বা সাক্ষাৎকার। আমি নিজে ব্র্যাকের ছাপাখানায় কাজ করতে খুব আগ্রহী ছিলাম। তখন ব্র্যাক প্রিন্টার্স ছিল দেশের মুদ্রণ জগতে আধুনিকতার প্রতীক। পদ্মা প্রিন্টার্স ছাড়া অন্য কোথাও এমন মানের কাজ হতো না।
আবেদ ভাইয়ের সঙ্গে আলাপচারিতার একপর্যায়ে তিনি হঠাৎ করেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার কি ঢাকার বাইরে কাজ করার ইচ্ছে আছে?’
প্রশ্নটা একটু অপ্রত্যাশিত লাগলেও আমি নির্ভরতা নিয়ে উত্তর দিলাম, ‘আসলে আমি ঢাকাতেই থাকতে চাই। যেহেতু প্রকাশনার কাজের সঙ্গে পরিচিত, সেজন্য ব্র্যাকের প্রকাশনা, পত্র-পত্রিকা কিংবা অন্যান্য সৃজনশীল কাজে যুক্ত হতে চাই।’
সব কথা মন দিয়ে শুনে তিনি বললেন, ‘তোমাকে শুরুতে যে সম্মানী দেওয়া যাবে, তা দিয়ে তোমার ঢাকায় চলা কঠিন হবে। তা ছাড়া আমাদের প্রধান কার্যালয়ের কর্মীসংখ্যা খুবই কম। এখানে যারা কাজ করে, তাদের সময়েরও বড় একটা অংশ মাঠপর্যায়ে কাজ করতে হয়।’
তারপরই যেন পরামর্শের ভঙ্গিতে বললেন, ‘ঢাকার বাইরে জীবনযাত্রার খরচ কম। মাঠপর্যায়ে কাজ করলে বাড়তি কিছু ভাতাও পাবে, যেটা দিয়ে মোটামুটি ভালোভাবে চলতে পারবে।’
আমি তখনও নিজের সিদ্ধান্তে অনড়, তবে লক্ষ করলাম-তিনি শুধু একজন কর্তা হিসেবে বলছেন না; বরং একজন অভিভাবকের মতো ভাবছেন আমি কেমন করে চলব, আমার জন্য কোন্ পথটা বাস্তবসম্মত হতে পারে এবং সেইমতো আমাকে বোঝাতে চাইছেন।
আমি তখন ব্যাখ্যা করে বোঝাতে চাইলাম—‘আমার ঢাকায় থাকাটা কেন জরুরি। বাবা কিছুদিন আগে দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে শয্যাশায়ী। ওনার দেখাশোনা, চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়াসহ সবকিছুই আমার ওপর নির্ভর করে। এই অবস্থায় ঢাকার বাইরে থাকা আমার পক্ষে কষ্টকর হবে।’
সবকিছু শোনার পর, বিশেষ করে বাবার অসুস্থতার কথা জানার পর আবেদ ভাই শেষ পর্যন্ত আমাকে প্রধান কার্যালয়ে কাজ করার সুযোগ করে দিলেন। তবে সঙ্গে এটাও জানাতে ভুললেন না যে, শুরুতে খুব একটা ভালো বেতন দিতে পারবেন না। কিন্তু আমার তখন আনন্দে আত্মহারা হওয়ার অবস্থা! কারণ এই প্রথম সত্যিকারের একটি চাকরি পেতে যাচ্ছি—যে চাকরির পেছনে এতদিন ধরে ছুটে বেড়াচ্ছিলাম।
আবেদ ভাইয়ের মতো এক মহান ব্যক্তিত্ব যখন আমার মতো একজন নবীন চাকরিপ্রার্থীর ছোট্ট একটি বিষয়কেও গুরুত্ব দিয়ে দেখেন, তখন বুঝতে পারি মহত্ত্ব কাকে বলে। তিনি শুধু পদের ভারে বড় ছিলেন না, মানুষের ভেতরের দিকটিও অনায়াসে ছুঁয়ে যেতে পারতেন। তাঁর সেই আচরণ আজও আমার জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষা হয়ে আছে। অল্প সময়ের মধ্যেই আমি তাঁর যে ভালোবাসা, মায়া, সহমর্মিতা ও মানবিকতা অনুভব করেছিলাম, তা আজীবনের জন্য আমার মনে গেঁথে আছে।
আবেদ ভাই বললেন, ‘আগামীকাল সকালে এসে মিসেস হাফিজের কাছ থেকে অ্যাপয়েনমেন্ট লেটার নিয়ে যেও।’ সেই রাতে উত্তেজনায় একটুও ঘুমোতে পারলাম না। পরদিন সকাল ঠিক ৯টার মধ্যে BRAC-এর হেড অফিসে হাজির হলাম। সোজা চলে গেলাম নাজমা আপার কাছে। তিনি হাসিমুখে আমাকে দেখে ড্রয়ার খুলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারের খামটি বের করে দিলেন।
খাম খুলে দেখি, আবেদ ভাইয়ের স্বাক্ষরসহ অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারে আমার মাসিক বেতন নির্ধারিত হয়েছে ৩ হাজার টাকা। সত্যি বলতে কী, বেতন কত সেটা তখন আমার কাছে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। মনে হচ্ছিল, গানের সেই কথাগুলো যেন নিজের জীবনের জন্যই লেখা—‘চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছো…’
১৯৯২ সালের ৪ঠা আগস্ট ব্র্যাকের প্রধান কার্যালয়ের প্রকাশনা বিভাগে পাবলিকেশন অ্যাসিসট্যান্ট হিসেবে আমি আমার পথচলা শুরু করি। এরপর কেটে গেছে ৩৩টি বছর, নিরলস আত্মনিবেদনে! সেই সময়ের ছোট্ট ব্র্যাক আজ বিস্তৃত ডালপালা মেলে এক বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়েছে।
ব্র্যাক আমার জন্য শুধু একটি চাকরিস্থল হয়ে থাকেনি, ধীরে ধীরে তা আমার জীবনের অংশ হয়ে গেছে। বিশ্বাস ও নির্ভরতার যে উদাহরণ ব্র্যাক তৈরি করতে পেরেছে, তা দেখে গর্বভরে অনুভব করি, এই সুনামের কোথাও হয়ত আমারও কিছু স্পর্শ রয়েছে।

প্রথম আলো-র প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে লেখক ও তার কন্যার সঙ্গে স্যার ফজলে হাসান আবেদ
প্রথম দিনের সেই অভিজ্ঞতা ভালোলাগা আর ভালোবাসার যে অনুভূতি তৈরি করেছিল, আজও তা আমার মনের গভীরে উজ্জ্বল হয়ে আছে। আজ ৮৯তম জন্মবার্ষিকীতে প্রয়াত আবেদ ভাইয়ের স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই এবং তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।



