সড়কে সমুদ্রের হাঙর

তারিখ: 16 আগ. 2018

লেখক: মোঃ ইমদাদুল খান সোহেল

সড়ক আজ জাতীয় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ছ’মাসে সড়ক থেকে আর বাড়ি ফেরেনি এমন প্রাণের সংখ্যা কমপক্ষে ২,৪৭১। ক্রমবর্ধমান এই সংখ্যা আমাদের আতঙ্কিত করে। সড়ক গহবরে কেন হারিয়ে যাচ্ছে তরতাজা প্রাণ সেটা অবশ্যই ভাবনার বিষয়।

সড়কে নিরাপত্তা চেয়ে কেন ছেলেমেয়েদের হাতে প্ল্যাকার্ড তুলে নিতে হলো? এই হাত দিয়ে তারা চালাবে শিক্ষার কলম, ক্রিকেটের ব্যাট কিংবা অঙ্কনের তুলি। অথচ ইউনিফর্ম পরিহিত এই শিশুকিশোররাই গাড়ি থামাচ্ছে। পরীক্ষা করে দেখছে গাড়ির লাইসেন্স। টিভি পর্দায় অথবা পত্রিকার পাতায় এসব ছবি দেখে আমরা সাবাস বলে হাততালি দিচ্ছি। কিন্তু কোনো অভিভাবকই সন্তানদের একাজগুলো করার জন্য স্কুলে পাঠায় না। নিজের চোখের সামনে সহপাঠীর মর্মান্তিক বিয়োগ দেখে শিশু-কিশোররা এই পথে নামতে বাধ্য হয়েছে।

এ প্রতিবাদ শুধু তাদের নিজেকে বাঁচাবার জন্য নয় বরং তারা প্রমাণ করেছে যে, বড় মানুষগুলো ঘরবন্দি থাকলে তাহলে দায়িত্ব তাদেরকেই তুলে নিতে হবে। বড়দের ব্যর্থতার মধ্যে ছোটদের এই সাফল্যের ঝলকানি কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়।

বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোর এই প্রতিবাদ একটি রাষ্ট্রের জন্য কতটা সুখকর? আগামী প্রজন্ম কতটা ঝুঁকিমুক্ত? সমাজ, রাষ্ট্র আজ এ প্রশ্নবাণে জর্জরিত। রাস্তায় প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়ানো শিশুটি যখন এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর থেকে বঞ্চিত হয়, তখন সে আইনকে নিজের মতো করে ব্যবহার করতে শেখে।

সড়কের কান্না সমাজের মানুষদের আতঙ্কিত করে। রাষ্ট্র নামক যন্ত্রটি যদি সড়কে সঠিকভাবে চলতে পারে তবেই শুধু এই রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক নিশ্চিন্তে এগোতে পারবে। যদি ব্যত্যয় ঘটে তাহলে সড়কের পিচ, বিটুমিন আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। তাতে ক্ষতিটা হবে রাষ্ট্রেরই। ক্রাচে ভর দিয়ে পোড়া পা নিয়ে চলতে হবে।

দুর্ঘটনা ছাড়াও সড়ক ব্যবস্থায় আছে আরও বেশ কিছু সমস্যা। সড়কে যে যানবাহন চলছে তাদেরকে দিনশেষে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা গচ্চা দিতে হয় চাঁদাবাজিতে। চাঁদাবাজি পরিবহন খাতে একটি দুরারোগ্য ব্যাধি। তাই লাভ-লোকসানের মারপ্যাঁচে পড়ে পরিবহন চালকেরা সড়কে গচ্চা দেওয়া টাকার হিসাব মেলাতে অতিরিক্ত ট্রিপ গাড়ি চালাতে বাধ্য হচ্ছে। সেই সঙ্গে বিরতিহীন গাড়িচালনায় ক্লান্তিতে হচ্ছে অবসাদগ্রস্থ, অবশেষে আশ্রয় খুঁজছে মাদকে। আবার গাড়ির লাইসেন্স মিলছে ঘুষ-দুর্নীতির আশ্রয়ে। লাইসেন্স প্রদানে নেই কোনো সঠিক ব্যবস্থাপনা।

এই দূর্বল ও অনিয়মের পথ থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে হবে কর্তৃপক্ষকে। সেই সঙ্গে এই প্রক্রিয়ার আধুনিকায়ন করতে হবে। অনলাইন ব্যবস্থার মাধ্যমে পুরো প্রক্রিয়াকে ঢেলে সাজাতে হবে। লাইসেন্স পরীক্ষায় আনতে হবে স্বচ্ছতা। আইনের হাত যদি শক্ত হয় তবে অবৈধ অর্থের কারবারও বন্ধ হবে। গোটা পরিবহন ব্যবস্থায় একটা শুভ পরিবর্তন আসবে। জনসাধারণের চলাচলের সুবিধার্থে ফুটপাত থেকে অবৈধ দোকান উচ্ছেদ করতে হবে। সচেতন করে তুলতে হবে সাধারণ মানুষকে সড়কে ওভারব্রিজ ব্যবহারে।

দশ-বারো বছর বয়সী যে ছেলেমেয়েগুলোর কাঁধে ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা, তারা ফাটিয়ে চিৎকার দিচ্ছে ‘ডাইরেক্ট গুলিস্তান, ডাইরেক্ট গুলিস্তান’, বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। এই শিশুরা তাদের মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত, একটু ভালো থাকার জন্যই তারা হয়তো ভবিষ্যৎহীন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সময়ের স্বার্থপরতায় একসময় গাড়ির স্টিয়ার হাতে নিচ্ছে, তখন দুর্ঘটনা অনিবার্য হয়ে উঠছে। তাই সবার আগে পরিবর্তন আনতে হবে এই সুনির্দিষ্ট অনিয়মের জায়গাগুলোতে। স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষিত চালকদের হাতে তুলে দিতে হবে যানবাহনের স্টিয়ারিং।

সময় আজ পরিবর্তনের পক্ষে। এই পরিবর্তন এনে দেবে আমাদের সন্তানেরা। তারা আইনকে প্রশ্ন করেছে। প্রশ্নের উত্তরে যে কিছুটা হলেও পরিবর্তন আসছে তা স্পষ্ট।

সড়কব্যবস্থার সঙ্গে দেশের অর্থনীতিও জড়িত ওতোপ্রোতভাবে। সড়কে যে কোনো অবরোধ মানেই পণ্যের চলাচল থেমে যাওয়া, বাজার ঊর্ধ্বমুখী হওয়া, জীবনযাত্রা থমকে যাওয়া- সড়কের অনিরাপত্তা এখানে প্রভাবিত করছে জনজীবন।

ঈদের মৌসুমে নিরাপদ সড়কের প্রসঙ্গ আরও বেশি করে উঠে আসে। তখন পথে থাকে অগণিত ঘরমুখী মানুষ, সড়কে তখন তীব্র ব্যস্ততা। উৎসবের এই সময়টায় নিয়ম মেনে চললে জীবন উৎসবমুখরই থাকে, তা কারো শোকের কারণ হয় না। সড়কপথের অনেক যানবাহনে আমরা লেখা দেখি ‘মা-বাবার দোয়া’। হ্যাঁ, অজস্র সন্তান চলেছেন মা-বাবার কাছে বা মা-বাবার সঙ্গে। সড়কের অভিশাপে এই আশীর্বাদ রূপ নেয় বেদনায়, মানুষকে পোড়ায় স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণায়।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিছু অপ্রিয় কথা বলতে হয়। আজ রাজধানীর বুকে এই সড়ক দুর্ঘটনাগুলো আমাদের ঘুম ভাঙিয়েছে। অনেকেই ছুটে যাচ্ছেন ভুক্তভোগীদের সান্ত্বনা দিতে। মিলছে ক্ষতিপূরণের টাকা। এই টাকায় গরিব বাবা হয়তো তার পরিবারের ভবিষ্যৎ গড়বে, কিন্তু এই টাকা কি বাঁচাতে পারবে সড়ক নামক হাঙরের মুখ থেকে অন্য কোনো সন্তানের প্রাণ? রাষ্ট্র তখন কী জবাব দেবে?

5 1 vote
ব্লগটি কেমন লেগেছে?