সংকটের ভেতর এক গুরুতর সংকটঃ রোহিঙ্গা অস্থায়ী আবাসে ডিপথেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই

তারিখ: 20 ডিসে. 2017

লেখক: ইফ্ফাত নওয়াজ

কক্সবাজারে জীবন যেন এখন শুধু ক্লান্তিহীনভাবে ছুটছে। মানবিক সহায়তা কর্মীদের জরুরী সহায়তা কার্যক্রম যেন বঙ্গোপসাগরের ঢেউ-এর মতই ছুঁয়ে যাচ্ছে প্রতিটি অস্থায়ী আবাস এবং সেখানকার মানুষদের। সাগরতীরে ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যায় যখন মানুষ এই বিপর্যয়ের গভীর থেকে গভীরে প্রবেশ করে বিপন্ন মানুষের সহায়তা কাজে নিজেদের সঁপে দেয়। প্রতিটি ঘন্টার প্রতিটি মুহূর্তে সেখানে সংকট মোকাবেলায় লিপ্ত মানবতার পতাকাবাহীরা।

কিন্তু গত সপ্তাহে ডিপথেরিয়া রোগের প্রকোপ চিহ্নিত হওয়ার কারণে এখন এমন এক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে যাকে এই চলমান সংকটের ভেতর আরেক জটিল সংকট হিসেবে বিবেচনা করতে বাধ্য করছে।

এমন এক পরিবেশ যেখানে প্রত্যেককে অন্যের নিঃশ্বাস ঘেষা দূরত্বে ঘুমোতে হয়, সেখানে ডিপথেরিয়ার মতো ছোঁয়াচে রোগের প্রকোপ কমিয়ে আনা একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। এই মানবিক বিপর্যয় মোকাবেলায় গঠিত ইন্টার সেকশন কোর্ডিনেশন গ্রুপের স্বাস্থ্য খাতে নেতৃত্বদানকারী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক দূর্যোগ মোকাবেলায় কর্মরত সবচেয়ে সক্রিয় সংস্থাগুলোর সাথে দীর্ঘ বৈঠক করেছে কি করে এই রোগের দ্রুত ছড়িয়ে পড়া রোধ করে হাজারো মানুষের জীবন বাঁচানো যায়। ব্র্যাক এই সক্রিয় সংস্থাগুলোর মধ্যে অন্যতম হিসেবে বিবেচিত।

সার্বিক সমন্বয়করণের এই বৈঠকগুলো কোন গতানুগতিক আলোচনার মতো ছিল না। ঘন্টার পর ঘন্টা ম্যাপের সামনে বসে কর্মপন্থা প্রণয়ন, বিভিন্ন মানুষের স্বাস্থ্যগত আচরণের ভিত্তিতে সংগৃহীত কেস পর্যালোচনা, বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্তকরণ এবং স্থানীয় বিভিন্ন ধারনা সংগ্রহ- এ সব কিছুই চলছে অবিরাম, প্রতিটি মুহূর্তে।

শুরুতে আমরা পরিস্থিতির গুরুত্ব, প্রেক্ষাপট অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং যে ধরণের সহায়তা আমরা প্রদান করতে সক্ষম- এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। ‘ডক্টরস্‌ উইথআউট বর্ডার্স’ (এমএসএফ) প্রথম ডিপথিয়েরিয়া আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে শুরু করে।

এই রোগটি ছোঁয়াচে হবার কারণে আক্রান্ত রোগীদের স্বাস্থ্য কেন্দ্র বা ক্লিনিকগুলোতে অন্যান্য রোগীদের থেকে আলাদা রাখার ব্যবস্থা করা জরুরী হয়ে দাঁড়ায়। ১০টি বিছানা সমেত একটি বিশেষ কক্ষ ব্যবস্থা চালু করা হয় যেখানে দিনরাত ২৪ ঘন্টা সার্বক্ষণিক দুই জন নার্স ও একজন ডাক্তার কর্তব্যরত থাকেন।

এতো দ্রুত এই বিশেষ ব্যবস্থা চালু করা কতজনের পক্ষে সম্ভব? এবং কত দ্রুতই বা মাঠকর্মীগণের পক্ষে অস্থায়ী আবাসের প্রতিটি পরিবারের কাছে গিয়ে এই ছোঁয়াচে রোগ ডিপথেরিয়া সম্পর্কে সচেতনমূলক বার্তা পৌঁছে দেয়া শুরু করা সম্ভব?

কক্সবাজারে অবস্থানরত এই মানবিক বিপর্যয় কার্যক্রমে অংশ নেয়া ব্র্যাকের প্রত্যেক কর্মী, স্বাস্থ্যসেবা দলসহ সকলেই যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর তাৎক্ষণিকভাবে এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রত্যেক কর্মসূচিতে শোনা গেল দৃঢ়প্রত্যয়ী আশার বাণী ‘আমাদের সামর্থ্য আছে, আমাদের কর্মীরা সহায়তা করতে প্রস্তুত।’

ইউনিসেফ এর সাথে আমাদের চলমান উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের অন্তর্গত ৮০০ রোহিঙ্গা নাগরিকও এর অন্তর্গত হয়, যারা আগে থেকেই এমন পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।

কুতুপালং থেকে উঁচিপ্রাং পর্যন্ত এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা অস্থায়ী আবাসের প্রতিটি পরিবারের কাছে তারা গিয়ে ডিপথেরিয়া মোকাবেলা বিষয় সচেতনমূলক দ্রুত প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলেন। শিশুবান্ধব কেন্দ্রগুলোতে যারা কাজ করছেন তারা এই রোগের লক্ষণ ও আক্রান্তদের চিহ্নিত করতে প্রশিক্ষণ লাভ করেছেন। ডিপথেরিয়া আক্রান্তদের খুঁজে বের করে সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে ব্র্যাকের স্বাস্থ্যকর্মীগণও অস্থায়ী আবাসের পরিবারগুলোর দুয়ারে গিয়ে উপস্থিত হতে লাগলেন।

এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই হাকিমপাড়া অস্থায়ী আবাসে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডাক্তার এবং নার্সসহ চালু হয়ে গেল একটি ২০ বিছানাবিশিষ্ট ডিপথেরিয়া চিকিৎসা কেন্দ্র। পরের দিন বালুখালি অস্থায়ী আবাস এলাকা, যেখানে এই রোগাক্রান্ত মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, সেখানে চালু হয়ে গেল ১০ বিছানাবিশিষ্ট আরও একটি ডিপথেরিয়া চিকিৎসা কেন্দ্র। আক্রান্ত রোগীগণের আক্রান্ত হবার উৎস নির্ণয়ে আরও তৎপর হলেন আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীগণ।

যে কাজগুলো নিয়ে এতো আলোচনা করা হলো, তার কোনটির বাস্তবায়নই খুব সহজ কাজ নয়। কিন্তু মুহূর্তকাল চিন্তা না করেই এই দায়িত্ব পালনে আমরা এগিয়ে এসেছি আমাদের চলমান কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি। আমাদের কাছে সবার ওপরে মানবতা, বিশেষ করে মানুষের প্রাণ যখন বিপন্ন।

ডিপথেরিয়া আক্রান্ত রোগী এবং যারা রোগাক্রান্ত বলে ধারণা করা হচ্ছে তাদের বয়স বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখবো এক-চতুর্থাংশই শিশু, যাদের বয়স ০-৫ বছরের অন্তর্গত। ৫-১০ বছর বয়সীরা এক-তৃতীয়াংশ স্থান দখল করে আছে এবং এক-পঞ্চমাংশের বয়স ১০-১৫ বছরের মধ্যে। মাত্র ১ ভাগের বয়স ১৫ কিংবা তার অধিক।

সামনে হয়ত আমরা আরও কঠিন পরিস্থিতির সম্মূখীন হতে পারি, কিন্তু তাতে পরিবর্তন হবে না আমাদের ডিপথেরিয়া আক্রান্তদের প্রতি সহায়তামূলক মনোভাবের। ডিপথেরিয়া থেকে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করা যায়, কিন্তু সময়মতো ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে এটি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।

কক্সবাজারে উপস্থিত সকল সংস্থার সমন্বিত চেষ্টার মাধ্যমে এই মহামারী রোধ করা সম্ভব। সেখানকার সকল সহায়তাকর্মীকে প্রতিরোধমূলক টিকা প্রদান করা হয়েছে যেন সেবাপ্রদানের পথে তারা নিজেরা অসুস্থ হয়ে না পড়েন। সাগরের ঢেউ-এর চেয়ে দ্রুতবেগে আমরা পৌঁছে গেছি বিপন্ন মানুষের ঘরের দোরগোরায়। বঙ্গোপোসাগর আজ আমাদের এই দুর্বার মহাযজ্ঞের সাক্ষী।

0 0 votes
ব্লগটি কেমন লেগেছে?