যে পাঁচটি নেতৃত্বগুণের কারণে আবেদ ভাই অনন্য

তারিখ: 11 ডিসে. 2024

লেখক: আসিফ সালেহ্

স্যার ফজলে হাসান আবেদ তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে শুধু একটি শক্তিশালীই প্রতিষ্ঠানই গড়ে তোলেননি, বরং বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের জীবনমান পরিবর্তনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ব্র্যাক কিংবা জাতীয় এনজিও আন্দোলন—এই দুই ক্ষেত্রেই তিনি অসংখ্য নেতৃত্ব তৈরি করেছেন। সেসব নেতারা তাঁর কাছ থেকে শিখেছেন, পরামর্শ নিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছেন এবং তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নে একাগ্রচিত্তে কাজ করেছেন। আবেদ ভাইয়ের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে যারা কাজ করেছি, তারা বুঝতে পেরেছি যে, আরেকজন ফজলে হাসান আবেদ কখনই তৈরি হবে না। তার মধ্যে এমন কী গুণাবলি ছিল, যা তাঁর নেতৃত্ব গুণকে অদ্বিতীয় করে তুলেছিল? তাঁর পাঁচটি অসাধারণ নেতৃত্বগুণের কথা বলব, যার মাধ্যমে তিনি সারাদেশে বিশ্বমানের অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।

১. সাহসী, উচ্চ ও দূরদর্শী লক্ষ্য নির্ধারণ

‘ছোটোই সুন্দর, কিন্তু বড় অপরিহার্য’ (Small is beautiful, large is essential) এ এক মন্ত্র, যা ব্র্যাকের অস্থিমজ্জার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিনি এমন লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন, যা করার জন্য অবশ্যই সাহসের প্রয়োজন হয়। বিস্ময়কর হলো প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি সফল হয়েছেন। বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে মায়েদের ওরস্যালাইন বানানো শিখিয়ে দেওয়া, দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর কাছে স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার (ল্যাট্রিন) পৌঁছানো কিংবা লক্ষাধিক অতিদরিদ্র মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা দেওয়া—সকল ক্ষেত্রেই সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি দূরদর্শী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন। সেই লক্ষ্য কীভাবে অর্জিত হবে, সে সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকার কারণে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা তাঁর পক্ষে সহজ হয়েছিল। তিনি অনেক বড় করে স্বপ্ন দেখতেন এবং অন্যদেরকে নিজের স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গা থেকে বের হয়ে আসার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি এমনই ব্যক্তিত্বের অধিকারী যে, সকলেই তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তাম।

২. সংখ্যায় বিশ্বাস

স্যার ফজলে হাসান আবেদ অবিশ্বাস্যরকমভাবে সংখ্যায় বিশ্বাসী। এই বিশ্বাস শুধু কোনো একটি বিষয়কে ভালোভাবে অনুধাবন করার জন্য নয়, বরং কার্যকারিতা পরিমাপের জন্যও তিনি সর্বদা প্রামাণিক তথ্য-উপাত্তের ওপর নির্ভর করতেন। ব্র্যাকের জন্মলগ্ন থেকেই তিনি গবেষণা ও মূল্যায়নের ওপর জোর দিয়েছেন, যে কারণে উন্নয়ন সংস্থাগুলোর মধ্যে ব্র্যাক সবচাইতে বড় গবেষণা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেছিল। চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট হওয়ায় অর্থসংক্রান্ত সংখ্যাগুলো সহজেই তিনি তাঁর মস্তিষ্কে ধারণ করতেন। ব্র্যাক প্রতিষ্ঠার এত বছর পরেও, তিনি এর আর্থিক প্রতিবেদনগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে সংস্থার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ধারণা নিতেন। হতে পারে তা ঈদের সময় আড়ংয়ে বিক্রির পরিমাণ কিংবা বিকাশ-এর লেনদেনের সংখ্যা, সবই তাঁর জানা থাকা চাই এবং প্রতি রাতেই তিনি এ সংক্রান্ত রিপোর্ট পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতেন। তাঁর ব্যবস্থাপনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো অনুসন্ধান ও তথ্য আদানপ্রদান। তিনি বলেন কম, কিন্তু শোনেন বেশি। তিনি বিশ্বাস করেন, যা পরিমাপ করা যায়, তা অর্জন করাও সম্ভব।

আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশনে কারুশিল্পীদের সঙ্গে

৩. নীতিনির্ধারণ থেকে পরিচালনায় সমান দক্ষতা

আজকাল দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানের শীর্ষে যারা অবস্থান করি, তারা পরিচালনাগত জায়গা থেকে সরে গিয়ে কৌশলগত বিষয়ের প্রতি মনযোগী হই। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশ, যেখানে মানুষের দক্ষতা সীমিত, সেখানে উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে বসে থাকা আদর্শ সিদ্ধান্ত নয়। ব্যাপারটি তিনি শুরুতেই বুঝেছিলেন। তিনি ছিলেন দূরদর্শী ও বিচক্ষণ নেতা, তারপরেও পরিচালনসংক্রান্ত কাজে সর্বদাই যুক্ত হতে চাইতেন। ব্র্যাকের সফলতা শুধু সংস্থার লক্ষ্যের ওপর নির্ভর করে আসেনি, বরং কীভাবে তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে নির্ভর করেছে তার ওপর। পরিচালন দক্ষতা, কার্যকারিতা এবং নির্ভুল কর্মসূচি প্রণয়ন বিগত দিনগুলোতে ব্র্যাকের কার্যক্রমকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। শুরুর দিকে কখনও কখনও রাত ২টা বা ৩টা পর্যন্ত পরিচালন কার্যক্রমের খুঁটিনাটি নির্ধারণে মিটিং করতেন। যে কোনো ধরনের সমস্যা সমাধানে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। কোনো সমস্যাই তাঁর কাছে ছোটো নয়, আবার কোনোটিকে তিনি অনতিক্রম্য বলেও মনে করতেন না। তিনি বুঝেছিলেন, বাস্তবসম্মত কৌশল প্রণয়ন করতে হলে, পরিচালনসংক্রান্ত বিষয়ে তাঁর সম্যক ধারণা থাকতে হবে। একটি প্রতিষ্ঠানের সফলতা অনেকাংশেই নির্ভর করে তার মাঠকর্মীদের সমস্যা সমাধানের দক্ষতার ওপর। পরিচালনার ছোটোখাটো বিষয়েও কি তিনি মনযোগী ছিলেন? হ্যাঁ, কিছুক্ষেত্রে ছিলেন। তবে একইসঙ্গে অন্য যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদেরকেও তিনি যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়েছেন। ছোটো কিংবা বড় কাজে পারদর্শিতার পাশাপাশি কখনও দূরদর্শী, কখনওবা পরিচালনার ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন-উভয়ক্ষেত্রেই নেতা হিসেবে তিনি অনন্য।

৪. কাজ বের করে নেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা

প্রতিভা খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে স্যার ফজলে হাসান আবেদের রয়েছে অসাধারণ দক্ষতা। মূলত সত্তর, আশি এবং নব্বইয়ের দশকেই ব্র্যাক বেড়ে উঠেছিল। বাংলাদেশের বর্তমান মানবসম্পদ পরিস্থিতি খুব বেশি আশানুরূপ নয়। সুতরাং আজ থেকে ৩০ বছর পূর্বের পরিস্থিতি কেমন ছিল তা সহজেই অনুমেয়। এ ক্ষেত্রে তিনি পরিশ্রমী এবং অনুপ্রাণিত কর্মীদলের সহায়তায় ব্র্যাকের কার্যক্রম এগিয়ে নিয়েছিলেন। ওই কর্মীরা হয়তো দক্ষতার বিচারে শীর্ষে ছিলেন না, কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর মতো সমস্ত যোগ্যতাই তাদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। খুব সাধারণ কর্মীকে তিনি নেতা হিসেবে তৈরি করেছেন, যারা দায়িত্বপালনের ক্ষেত্রে সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়েছিলেন। প্রতিভা খুঁজে বের করে প্রশিক্ষণ এবং কার্যক্ষেত্রে স্বাধীনতা দেওয়ার পাশাপাশি তিনি তাদের কাছে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। বাংলাদেশের এনজিও অঙ্গনে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে, যিনি স্যার আবেদের সাহচর্যে পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ পাননি।

৫. ভুল ও ব্যর্থতা স্বীকারে পিছপা হননি

যে বৈশিষ্ট্যগুলো অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে ব্র্যাককে আলাদা করেছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো নেতৃত্বের সততা। ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুহার কমিয়ে আনার জন্য ওরাল রিহাইড্রেশন স্যালাইন থেরাপির কথা সকলেই জানেন। বাংলাদেশের মানুষের কাছে ‘একমুঠ গুড়, এক চিমটি লবণ এবং আধাসের পানি’ এই শব্দগুলো পরিচিত। কীভাবে খাওয়ার স্যালাইন বানাতে হবে, তা স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মায়েদের শিখিয়ে দিয়েছিলেন। এর সঙ্গে ছিল গণমাধ্যমে প্রচারণার কার্যকরী একটি পদক্ষেপ। এই দুইয়ের সম্মিলনে তৈরি প্রচারণার কাজটি লক্ষ লক্ষ শিশুর জীবন বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু এই কাজটি এক রাতের মধ্যে করে ফেলা সম্ভব হয়নি। তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন যে, শুরুর দিকে এই কার্যক্রমের ফলাফল ছিল হতাশাজনক। এরপর গবেষক ও পর্যবেক্ষকদের নিয়মিতভাবে পাঠানো হতো কীভাবে কার্যক্রমকে আরও কার্যকরী করা যায়, তা খুঁজে বের করার জন্য। তাদের লক্ষ্য ছিল স্যালাইন বানানো শেখার পাশাপাশি শিশুদের ডায়রিয়া হলেই যাতে তাদের স্যালাইন খাওয়ানো হয় সে বিষয়ে মায়েদেরকে সচেতন করা। এভাবে ভুল ও ব্যর্থতা স্বীকার করা এবং তা থেকে শিক্ষা নেওয়ার মানসিকতাই ব্র্যাককে একটি শিক্ষণধর্মী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। ব্র্যাকের বাইরের খুব কম মানুষই জানেন যে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্র্যাক আত্মসমালোচনার মাধ্যমে সর্বদাই উন্নয়নের ক্ষেত্রগুলোকে খুঁজে বের করার জন্য কীরকম সচেষ্ট থেকেছে। এই সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানের ওপর থেকে নিচে পর্যন্ত প্রবহমান।

ব্র্যাক স্কুলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে

নেতৃত্বের গুণাবলির কারণে আবেদ ভাই বেসরকারি ক্ষেত্রের যে কোনো সংস্থার একজন তারকা ব্যক্তিত্বে পরিণত হতে পারতেন। কিন্তু বাংলাদেশ এবং বিশ্ববাসীর সৌভাগ্য যে, আবেদ ভাই উন্নয়ন ক্ষেত্রের কাজের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন এবং তিনি তাঁর দক্ষতা ও দৃঢ়তা দিয়ে এই ক্ষেত্রকে সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন দেশের সবচাইতে সফল কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এর পাশাপাশি অতিদারিদ্র্য মোকাবিলায় সবচেয়ে কার্যকর উদ্ভাবন যেমন : আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম ও ওয়ান রুম স্কুল মডেল, যা তাঁরই চিন্তার ফসল। দরিদ্র মানুষের প্রতি তিনি সবসময় সমব্যথী থেকেছেন, তাদের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে তাদের দুঃখ-কষ্ট অনুধাবন করার মাধ্যমেই তিনি কার্যকর দারিদ্র্যবিমোচন কর্মসূচি প্রণয়নে সক্ষম হয়েছেন। দরিদ্র মানুষের প্রতি সহানুভূতি এবং অসাধারণ বাণিজ্যবিষয়ক ধারণা—এই দুটো বিরল গুণাবলির সংমিশ্রণেই ব্র্যাক এবং ব্র্যাকের সোশাল এন্টারপ্রাইজগুলোর সফলতার গল্প রচিত হয়েছে।

 

অধুনালুপ্ত ব্র্যাকের অভ্যন্তরীণ মুখপত্র ‘সেতু’-র বর্ষ-৩৪, জুলাই-আগস্ট ২০১৯ সংখ্যায় লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল

5 1 vote
ব্লগটি কেমন লেগেছে?