প্রিয় আবেদ ভাই,
বছর ঘুরে আবার এলো ২৭শে এপ্রিল, আপনার জন্মদিন! এবার আর আপনি নেই। রয়ে গেছে আপনার অজস্র স্মৃতি, আর আপনার দীপ্তিময় উপস্থিতির অগণিত সব সাক্ষী।
আপনি নিজেই দেখে গেছেন, সমাজের দরিদ্র মানুষ ও অবহেলিত নারীদের জন্য আপনার প্রচেষ্টাগুলো দেশের সীমানা পেরিয়ে সুদূর আফ্রিকা পর্যন্ত পৌঁছেছে। কুসংস্কার আর অবহেলার হাত থেকে বাঁচিয়েছেন অনেক জীবন, ছড়িয়ে দিয়েছেন জ্ঞান অর্জনের সুযোগ। আজ যখন সারা বিশ্ব দিশেহারা এক ভয়ংকর প্রাণঘাতী মহামারির আক্রমণে, তখন আমাদের অস্থির মন বারবার স্মরণ করছে আপনাকে, আপনার সময়োপযোগী চিন্তাশক্তিকে।
আপনাকে যখন আমি প্রথম দেখি, তখন আমার বয়স মাত্র ১২ বছর। বানিয়াচংয়ে আমার বাড়ি। আমাদের সেই বাড়ির অব্যবহৃত একটি বাংলো ঘরে বয়স্কদের শিক্ষার জন্য এক নতুন স্কুল উদ্বোধন হবে। সকাল থেকেই দেখেছিলাম আব্বা ভীষণ ব্যস্ত। বাংলো ঘর পরিষ্কারপরিচ্ছন্নতার কাজ নিজেই তদারকি করছেন, আবার কখনও নিজেই হাত লাগাচ্ছেন কাজে। আব্বা আয়োজনে কোনো খুঁত রাখতে চাননি, তাই এত ব্যস্ততা! বারবার বলছিলেন আজ আপনি আসবেন। তখন তো এত কিছু বুঝিনি! আমাদের বাড়িতে প্রায়ই বিশিষ্টজনেরা আসতেন, আসতেন জাঁদরেল সব সরকারি অফিসার। কিন্তু এটা আমি বলতে পারি, আব্বাকে কখনও ওতোটা ব্যস্ত হতে দেখিনি।
দুপুরবেলা ছোটো ইঞ্জিনের নৌকা করে আমাদের ঘাটে এসে আপনি নামলেন। সাথে ছিলেন আরও দুই-তিনজন। নতুন স্কুল ঘরে আব্বা আপনাকে নিয়ে গেলেন। পেছনে পেছনে আমরা ছোটোরাও কয়েকজন চলছিলাম। কী হচ্ছে তা নিয়ে আমাদের কৌতূহল তখন আকাশছোঁয়া! কিন্তু পরিস্থিতি আমাদের পক্ষে ছিল না! আমাদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দেবার জন্য দুয়েকজন ছিলেন বেশ তৎপর। বিষয়টা স্বাভাবিকভাবেই আমাদের কিশোর মন ভালোভাবে নিচ্ছিল না।
কিন্তু এরপর আমার অবাক হবার পালা। অনেক মানুষের ভিড় থেকে ভীষণ শান্ত আর নরম সুরে তখন কেউ একজন বললেন, ‘বাচ্চাদের তাড়ানোর দরকার নেই, ওরা থাকুক না! ওদের বরং সামনে দিয়ে দেন।’ আমাদের তখন আর পায় কে! অতি আগ্রহ নিয়ে ঘরের একদম সামনের দিকে গিয়ে বসলাম আমরা কজন। সামনে বক্তা একজনই, যিনি নিজেই কিছুক্ষণ আগে আমাদের সামনে বসতে দিতে বলছিলেন। কাঁচাপাকা চুলের শান্ত, সৌম্য আবেদ ভাই।

সেদিন আপনি অনেক কথা বলেছিলেন, বেশিরভাগই আজ আর আমার মনে নেই! তবে একটি কথা দুই যুগ পরেও মনে আছে, “আপনারা সবাই আপনাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাবেন, ছেলে আর মেয়েতে বিভেদ করবেন না, আপনারা যদি সময় মতো স্কুলে যেতেন তাহলে আজ এই বয়স্ক স্কুলের দরকার হতো না”- স্কুল উদ্বোধন শেষে আপনি কথাগুলো বলছিলেন। চলে যাবার আগে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গ্রামের নিরক্ষর এবং স্বল্পশিক্ষিত মানুষদের সাথে অনেক সময় ধরে আপনি কথা বলছিলেন। এমনভাবে কথা বলছিলেন যেন তারা সবাই আপনার কতদিনের চেনা! মানুষের খুব কাছে গিয়ে মানুষকে বোঝার এক বিস্ময়কর ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিলেন আপনি।
সেই দেখার পর বহুকাল আর আপনাকে দেখিনি। মাঝখানে পেরিয়ে গেছে ১৬টি বছর! সেই ছোট্ট আমি পড়াশোনা শেষ করলাম। বিদেশি এক প্রতিষ্ঠানে কিছুদিন চাকরি করলাম। তারপর সেই চাকরি ছেড়ে আপনার হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকে চলে আসি! তখনও বুঝে উঠতে পারিনি কী বিস্ময় অপেক্ষা করছে আমার জন্য। যত দিন যায়, মনে হচ্ছিল আমার সামনে যেন এক-একটা জানালা খুলে যাচ্ছে! আমি ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করি স্যার আবেদকে, ব্র্যাককে।
আমি অতি ক্ষুদ্র, কিন্তু এটুকু বুঝতে বেশি সময় লাগেনি যে, মানুষের প্রতি অগাধ বিশ্বাস আপনাকে আর দশজন থেকে আলাদা করেছিল। দু-একবার খুব অল্প সময়ের জন্য সামনাসামনি দেখা হলেও সালাম বিনিময় ছাড়া আর কোনো কথা হয়নি। প্রগাঢ় বিস্ময়ে আপনার দিকে শুধু তাকিয়েই থেকেছি কারণ ততোদিনে আপনি জীবন্ত কিংবদন্তি। সংকোচে কখনও বলা হয়ে ওঠেনি ১৯৯৫ সালে আপনি আমাদের বাড়ি গিয়েছিলেন।
ব্র্যাক সেন্টারের করিডোরেও আপনাকে কতদিন দেখেছি! কিন্তু লজ্জা, আড়ষ্টতা ভেঙে আমি কখনও একবারের জন্যও আপনাকে বলতে পারিনি যে আমিও বানিয়াচংয়ের ছেলে, যেখানে আপনি জন্ম নিয়েছেন, প্রিয় আবেদ ভাই!
আমাদের বাংলো ঘরটা দীর্ঘদিন ব্র্যাক বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য বিনা ভাড়ায় দিয়েছিলেন আব্বা। স্কুলের পড়া শেষ হলে মেঝে থেকে ভেঙে যাওয়া সাদা চক পেতাম আমি। সেই স্কুলের সঙ্গে আছে আমার কতো স্মৃতি। আহা, আড়ম্বরহীন সে স্কুল!
আবেদ ভাই, আমি সেই সৌভাগ্যবানদের একজন যে আপনার শেষ বিদায়ের খাটিয়া কাঁধে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছি। আপনার চলে যাওয়ায় ভীষণ ব্যথিত হয়েছিলাম। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় আপনি মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন সকলের প্রিয় আবেদ ভাই হয়ে। আপনার প্রিয় রবীন্দ্রনাথ দিয়েই শেষ করব এই লেখা! আপনি চলে যাবার পর আপনার আবৃত্তি শুনেছি বারবার। কি নির্মোহ, আর কি সাবলীল সেই আবৃত্তি!
জীবনেরে কে রাখিতে পারে
আকাশের প্রতি তারা ডাকিছে তাহারে…
তার নিমন্ত্রণ লোকে লোকে নব নব পূর্বাচলে আলোকে আলোকে…
তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ…
অনুলিখন ও সম্পাদনা: সুহৃদ স্বাগত ও তাজনীন সুলতানা



