“আমারে তো জবাই দিয়ে ফেলত! একদিন আমার স্বামী আমারে কয়- যা, তোর ভাইয়ের কাছ থেকে এক লক্ষ টাকা নিয়ে আয়গে; আমি অটো কিনব। আমি তখন কইলাম- আমি টাকা আনতি পারব না। তোর লাগবে তুই গিয়ে চা। তখন রাইগে গিয়ে আমার গায়ে হাত তোলে। আমার স্বামী অন্যদেরকে বলে- শুধু হাত-পা ধর; যা করার করে ফেলবনে। লোকে টের পাবে না।
ননদ, দেবর, ভাসুর আর শাশুড়ি মিলে আমার হাত পা ধরে মাটিতে ফেলে দেয়। আমার স্বামী গলার ওপরে এমনভাবে চেপে বসে যে আমার জিভ বের হয়ে যায়। আমার স্বামী তখন বলছিল- এখনি জবাই করে দেই, তোর বাপ-মাও খুঁজে পাবে না! এমন সময় আমার নন্দাই (ননদের স্বামী) এসে আমাকে বাঁচায়। পরে সে-ই আমার ভাইকে ফোন করে গোপনে বাড়ি আসার ব্যবস্থা করে দেয়।” – এই কথাগুলো বলছিলেন যশোর সদর উপজেলার জ্যোৎস্না (ছদ্মনাম)। দিনরাত্রি এই দুঃস্বপ্ন তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
মা মারা যাওয়ার কারণে ৫ম শ্রেণির পর পড়ালেখা শিকেয় তুলে রাখতে হয়েছিল জ্যোৎস্নার। ২০১৯ সাল। ১৭ ছুঁই ছুঁই কিশোরী জ্যোৎস্নার বিয়ে হয় তার বড় ভাইয়ের এক বন্ধুর ঘটকালিতে। পাত্রপক্ষ দেখতে আসার দিনে সে পালিয়ে খালার বাড়ি চলে যায়। পরে তার বাবা ও ভাইয়েরা অনেক বুঝিয়ে বাড়িতে নিয়ে এসে বিয়েতে রাজি করায়। বিয়ের বছরখানেক পর থেকেই শুরু হয় অত্যাচার। দুই বছরও সংসার টেকেনি। ২০২১ সালে চলে আসতে হয় বাবার বাড়ি। ২০২২ সালে ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন ও আইনি সুরক্ষা কর্মসূচির মাধ্যমে দেনমোহর ও ভরণপোষণ পাওয়ার জন্য তিনি অভিযোগ দায়ের করেন।
জ্যোৎস্নার ভাষ্যমতে –
“শুনেছিলাম ছেলে (পাত্র) অনেক ভালো চাকরি করে; প্রায় ৩০-৪০ হাজার টাকা বেতন। আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু সম্বন্ধ নিয়ে আসে, তাই পরিবার থেকে বিশেষ কোনো খোঁজ খবর না নিয়েই বিয়ের আয়োজন করে। কিছুদিন পর থেকেই শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমার সাথে খারাপ ব্যবহার শুরু করে। নানান বাহানায় আমার শ্বশুর, স্বামী এরা আমার ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা নেয়, বাবার কাছ থেকে টাকা নেয়। দিনে দিনে তাদের চাহিদা বাড়তে থাকে, বাড়ে আমার ওপর অত্যাচারের মাত্রাও।”
২০২২ সালে যশোর জেলায় মোট ৯৮৪ জন ভুক্তভোগী আইনি সেবা ও পরামর্শের জন্য অভিযোগ দায়ের করেন যার মধ্যে ৮৫১ জন আসেন দেনমোহর ও ভরণপোষণ পুনরুদ্ধার সম্পর্কিত অভিযোগ নিয়ে। ৯৮৪টি অভিযোগের মধ্যে ৮৪৪টি অভিযোগ সমাধানের জন্য গৃহীত হয়। গৃহীত অভিযোগের ৮৯ শতাংশ (৭৫৭টি) ছিল দেনমোহর ও ভরণপোষণ পুনরুদ্ধার সম্পর্কিত। তার মধ্যে ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন ও আইনি সুরক্ষা কর্মসূচির প্রচেষ্টায় ৩২৮টি অভিযোগ বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে মীমাংসা করা হয়েছে যার ৩০০টি ছিল দেনমোহর ও ভরণপোষণ সংক্রান্ত।
দেনমোহর ও ভরণপোষণ পুনরুদ্ধারের যতগুলো অভিযোগ মীমাংসা হয় তার মধ্যে ১৬৫ জন (৫৫ শতাংশ) অভিযোগকারীর বয়ান অনুযায়ী তাদের বয়স আঠারো পার হওয়ার আগেই (১২ থেকে ১৭ বছর বয়সে) বিয়ে হয়েছে। ৩০০ জন ভুক্তভোগীর প্রায় ৭২ শতাংশ অভিযোগকারী মাধ্যমিক স্কুলের গণ্ডি পার হতে পারেননি। একই ধরনের অভিযোগ নিয়ে আসা ভুক্তভোগীদের মধ্যে ২০৩ জনের (প্রায় ৬৮ শতাংশ) অভিযোগকালীন সময়ে বয়স ছিল ১৪ থেকে ২৫ এর মধ্যে। (তথ্যসূত্র: সেল্প এমআইএস সফটওয়্যার – ২০২২) ।

তথ্যসূত্র: সেল্প এমআইএস সফটওয়্যার
দেনমোহর ও ভরণপোষণ সংক্রান্ত যতগুলো অভিযোগ গৃহীত হয়েছে বা মীমাংসা হয়েছে তার সবগুলোর চিত্র এক নয়। দেনমোহর ও ভরণপোষণের অভিযোগগুলো নারীরা কী কী কারণে করছেন তার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যৌতুকের কারণেই বেশিরভাগ নারী আর সংসার করতে চান না। ২০২২ সালের সেল্প এমআইএস-এর তথ্য অনুযায়ী এ ধরনের অভিযোগের যতগুলো (৩০০টি) মীমাংসা হয়েছে তার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি (৫৫ শতাংশ) নারী বাল্যবিয়ের মুখোমুখি হয়েছেন।
বয়ঃসন্ধিকাল শেষ হওয়ার সঙ্গেসঙ্গে মেয়েদের বিয়ে নিয়ে পরিবারের মধ্যে একধরনের দুশ্চিন্তা তৈরি হয়। পরিবারের লোকজন ভাবে- মেয়েকে তো বিয়ে দিতেই হবে; তাই যত তাড়াতাড়ি দেওয়া যায় ততই ভালো। সাথে যোগ হয় প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের চাপ, বহুবছর ধরে চলে আসা ঐতিহ্য এবং সামাজিক নিরাপত্তার ভয়। পরিবারের চেনাজানা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখে এমন কেউ যদি পাত্রের সন্ধান দেয় তখন আর বিশেষ খোঁজখবর নেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না। অন্যদিকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পরিবারগুলো চিন্তা করে যে- স্বগোত্রীয় পরিবারের সাথে সম্বন্ধ করা শ্রেয় কিংবা কাছাকাছি আর্থ-সামাজিক অবস্থা হলে দুই পরিবারের মধ্যে বোঝাপড়াটা ভালো হয়, মেয়েকে ছোট করে দেখে না ইত্যাদি। আর মা-বাবার অবর্তমানে মেয়েটার যাতে ‘একটা গতি হয়’ সেজন্য অভিভাবক (বিশেষত বাবা) থাকতে থাকতেই মেয়ের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করে রাখার অন্যতম উপায় হয়ে ওঠে মেয়েকে অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া।
পরিবারের ভাষ্যমতে, ১২-১৩ বছর বয়সে পা দিলেই একটা মেয়ে সেয়ানা (বিয়ের উপযুক্ত) হয়ে ওঠে। যেমনটি ঘটেছে যশোর সদর উপজেলারই আরেক কিশোরী রেখার (ছদ্মনাম) বেলায়। রেখার বিয়ে হয় ৮ম শ্রেণিতে পড়াকালীন; তখন তার বয়স মাত্র ১৪। রেখার দাদি বলেন-
“আমাগে মেয়ে তো দেখতি শুনতি ভালো, মানষির নজর পড়ে। কোনসময় কী হয় তাই আগেভাগেই বিয়ে দিয়ে দিলিই ভালো। আবার বয়স বাইড়ে গেলি তো সিরাম ছাওয়ালও পাওয়া যাবি না। ঝামেলা কমাতি গিয়ে মেয়েডার বিয়ে দিছিলাম; এখন উল্টো আরও বড় ঝামেলা বাধায় নিছি।”
রেখা ক্লাসে প্রথমসারির ছাত্রী ছিলেন। সংসারে অভাব ছিল না। মা-বাবা চাইলে পড়ালেখা করাতে পারতেন। রেখার দাদা তখন অসুস্থ, তার খুব শখ তিনি নাতনির বিয়ে দেখে মারা যাবেন। অগত্যা রেখার বাবা নিরুপায় হয়ে তার বাবার (রেখার দাদার) অন্তিম ইচ্ছাপূরণ করার জন্য বিয়ে ঠিক করেন। রেখার বাবা মারা গিয়েছেন বছর দুয়েক হলো, তার দাদাও বেঁচে নেই। মা স্থানীয় এক ডাক্তারের সহকারী হিসেবে কাজ করছেন। ২০২২ সালে রেখাও এসেছিলেন ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন ও আইনি সুরক্ষা কর্মসূচির মাধ্যমে আইনি সহায়তা নিতে। সংসার টেকেনি, এখন এক সন্তান নিয়ে রেখা তার বাবার বাড়িতেই থাকছেন। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী এমন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জবাব দেন- “জানি না…।”
এমন সুবিধাবিঞ্চত নারীদেরকে আইনি সুরক্ষা প্রদান, ন্যায়বিচারের প্রবেশগম্যতা বৃদ্ধি এবং কিশোরীদের বাল্যবিয়ে হ্রাসের লক্ষ্যে ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষতায়ন ও আইনি সুরক্ষা কর্মসূচি যাত্রা শুরু করে। সেই ধারাবাহিকতায় ৩১টি জেলার ২৪০টি উপজেলাতে এই কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। ২০২২ সালে সামাজিক ক্ষমতায়ন ও আইনি সুরক্ষা কর্মসূচি থেকে ১৭ হাজারের অধিক ভুক্তভোগী নারী ও শিশুকে আইনি সহায়তা এবং পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে। প্রায় ছয় হাজার অভিযোগ বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে সমাধান করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে কর্মসূচি থেকে বাল্যবিয়ে হ্রাসের লক্ষ্যে ৫০ হাজারেরও অধিক কিশোরীর (১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সী) তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে যারা বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে আছে। এ সকল কিশোরীদেরকে নিয়ে ‘স্বপ্নসারথি’ দল গঠন করা হয়েছে যার লক্ষ্য হলো জীবনদক্ষতা উন্নয়নের মাধমে তাদের আত্মবিশ্বাসী করে তোলা। এর মাধ্যমে তারা নিজেরা বাল্যবিয়ে বিষয়ে সচেতন হবে ও প্রতিরোধ করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
সম্পাদনা: তাজনীন সুলতানা
কারিগরি সহযোগিতা: ফুয়াদ রাব্বী শুভ্র



