মোঃ আমিনুল আলম দেশের প্রতিটি গৃহস্থালিতে উচ্চারিত কোনো নাম নয়, যে ধরনের মানুষকে বলা হয় স্বনামেই ধন্য, এরকম কোনো মানুষও তিনি নন। তবে একথা না বললেই নয় যে, এদেশের প্রত্যন্ত জনপদে এবং বহির্বিশ্বে পৃথিবীর অনেকগুলো দেশে কোটি কোটি মানুষের মনের গভীরে তিনি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। মাত্র ৬১ বছরের আয়ু তাঁর, অথচ কী বিপুল তাৎপর্যেই-না তিনি তাঁর জীবনকে উদ্ভাসিত করে গেলেন! সর্বশেষ কর্মপরিচয়ে তিনি ছিলেন ব্র্যাকের আন্তর্জাতিক কর্মসূচির নির্বাহী পরিচালক, কিন্তু বেসরকারি উন্নয়নপ্রচেষ্টার ইতিহাসে ব্র্যাকের উত্থান, অগ্রগতি ও বিস্তারপর্বে যে ভূমিকা তিনি পালন করেছেন, প্রচলিত কোনো বিশেষণে তার ব্যাপ্তিকে চিহ্নিত করা সত্যিই দুরূহ কাজ।
ফজলে হাসান আবেদের নেতৃত্বে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার তিন বছর পর এই সংস্থায় তিনি যোগদান করেন, তারপর তিনি আর পেছনে ফিরে তাকান নি। দীর্ঘ পঁয়ত্রিশটি বছর উন্নয়নকর্মযজ্ঞে ফজলে হাসান আবেদের পাশে থেকে বিরামহীন কর্মপ্রয়াসে তিনি তাঁর জীবনকে উৎসর্গ করে গেছেন। আবেদের উন্নয়নচিন্তার সঙ্গে আমিনের বাস্তব অভিজ্ঞতা মিলিত হয়ে এক বেগবতী স্রোতঃস্বিনীতে পরিণত হয়েছিল। আবেদের মনের কথা বোঝার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তাঁর। সেজন্যই ব্র্যাকে যে কোনো কর্মসূচির বাস্তবায়নে তিনি ছিলেন অগ্রসেনানী। বস্তুত ব্র্যাক যে আজ দেশেবিদেশে সুবিশাল অবয়বে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে, এর পেছনে আমিনের অবদান প্রায় তুলনাহীন।

সহকর্মীদের সঙ্গে আমিন ভাই
ছাত্রজীবনে আমিনুল আলম মার্কসবাদী চিন্তার সংস্পর্শে এসেছিলেন। তবে পরবর্তী কর্মজীবনে তাঁর মধ্যে সেই আদর্শিক প্রবণতা ছিল না। দারিদ্র্যমুক্তির সংগ্রামটাকে তিনি নিজের মধ্যে অন্যভাবে বিন্যস্ত করে নিয়েছিলেন। তিনি দৃঢ় বিশ্বাসে উপনীত হয়েছিলেন যে, দরিদ্র মানুষকে যদি স্বাবলম্বী করে তোলা যায়, তবে তারা দারিদ্র্যকে জয় করতে পারবে। বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল—এসবকিছুকে আরও উৎকৃষ্ট করে তোলাই ছিল তাঁর স্বপ্ন ও সাধনা।
আমিনুল আলম তাঁর বিরামহীন কর্মপ্রয়াসে এদেশের তৃণমূলবাসী মানুষের সঙ্গে আক্ষরিক অর্থেই একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। তৃণমূলের দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের উন্নয়নেই ছিল তাঁর আত্মার প্রশান্তি। বিশেষত নারী উন্নয়নে তাঁর আগ্রহ ছিল অপরিসীম। আমার মনে আছে, ১৯৯৪ সালে আমিনের সঙ্গে ব্র্যাকের কর্মসূচি দেখার জন্য আমি একবার দিনাজপুরে গিয়েছিলাম। সেখানে গ্রামসংগঠনের এক মহিলার মিষ্টির দোকানে বসেছিলাম আমরা। ছয় হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ঐ মহিলা দোকানটি শুরু করেছেন। দেখলাম, এক সুঠামদেহী পুরুষ ঐ দোকানে সহকারী হিসেবে কাজ করছেন। জানা গেল, পুরুষটি ঐ দোকানি মহিলার স্বামী। স্ত্রীর দোকানে কাজ করতে লজ্জা করে কি না, এই প্রশ্নের উত্তরে পুরুষটির ত্বরিত জবাব: কেন লজ্জা করবে? ও তো আমাকে মাইনে দেয়। আমিনুল আলম এই জবাব শুনে খুব প্রীত হয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘দেখুন, নারীর ক্ষমতায়নে কীভাবে কাজ এগিয়ে চলেছে।’

সাধারণ মানুষের সঙ্গে আমিন ভাই
ব্র্যাক যখন বহির্বিশ্বে তার কর্মসূচি সম্প্রসারিত করল, তখন স্বদেশের মতো সেখানেও আমিন সৈনাপত্য গ্রহণ করলেন। কয়েক বছরের মধ্যেই এশিয়া-আফ্রিকার দশটি দেশে তিনি কর্মসূচির বিপুল বিস্তার ঘটালেন। একমাত্র হাইতি ব্যতীত আমিনুল আলমের সঙ্গে ঐ দেশগুলোর সবকটিতেই আমি গিয়েছি। সিয়েরালিওনে সেদেশের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলাম আমরা। আমি দু-চারটি কথা বলে যখন আমিনুল আলমকে ব্র্যাক সম্পর্কে বলতে বললাম, তখন আমার বিস্মিত হওয়ার পালা। ইংরেজি ভাষায় আমিনের দখল চমৎকার ছিল, একথা বলা যাবে না। কিন্তু আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, অসম্ভব স্বতঃস্ফূর্ততায় আমিনুল আলম ব্র্যাককে ব্যাখ্যা করে চলেছেন। ভাষাগত নৈপুণ্যের প্রশ্নটি পুরোপুরি অবান্তর হয়ে গেছে। দেখলাম, প্রেসিডেন্ট মহোদয় তাঁর নোটবই টেনে নিয়ে দ্রুত আমিনের বক্তব্যের নোট নিচ্ছেন।

তাঞ্জানিয়ার জাঞ্জিবারে গ্ৰাম সংগঠন (ভিও) পরিদর্শনকালে ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে আমিনুল আলম (সর্ববামে)
অঙ্গীকারে এবং কর্মদক্ষতায় আমিনুল আলম নিঃসন্দেহে এক উচ্চ শিখরকে স্পর্শ করেছিলেন। কাজ, কাজ এবং কাজ-এর বাইরে তাঁর অন্য কোনো জীবন ছিল না। তিনি তাঁর সমস্ত জীবনযাপনের মধ্যে একটিই বাণী রেখে গেছেন, আর তা হলো, কর্মের মধ্যে, আত্মোৎসর্গের মধ্যেই জীবনের সার্থকতা। আমার বলতে কোনো দ্বিধা নেই, বাংলাদেশে তিনি আমাদের প্রজন্মের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান।
আমিনুল আলম দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে, অশিক্ষার বিরুদ্ধে বিরামহীন সংগ্রাম করে গেছেন। বাংলাদেশের তরুণী বিধবা কিংবা লাইবেরিয়ার গৃহযুদ্ধে ধর্ষিতা নারী উভয়ের জন্য তাঁর সমবেদনার গভীরতা ছিল সমান। বিশ্বের বঞ্চিত ও দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের জন্য তাঁর সংগ্রাম অমলিন হয়ে থাকবে। আমিনুল আলম কোনো সুপরিচিত মানুষ ছিলেন না। তবে তিনি যদি সুপরিচিত হতে চাইতেন, তবে যে আমিনকে আমরা বিদায় জানিয়েছি, তিনি সেই আমিন হতেন না, তখন তিনি হতেন অন্য আমিন! ক্ষণজন্মা এই মানুষটিকে আবারও অভিবাদন।



