জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীব্যাপী প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা ও মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি, বন্যা, খরা, তাপদাহ, দাবানলের মতো দুর্যোগে পৃথিবীর প্রতি প্রান্তই কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, আগামী ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ তাপমাত্রা বৃদ্ধি। আর, তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ। শিল্পকারখানা ও যোগাযোগ খাতে জীবাশ্ম জ্বালানির অতিরিক্ত ব্যবহার, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং কৃষি সম্প্রসারণের ফলে ২০১৯ সালে বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে রেকর্ড ৩৬.৪৪ বিলিয়ন মেট্রিক টন। অথচ ২০ বছর আগেও এর পরিমাণ ছিল ২০ বিলিয়ন মেট্রিক টন। এই কার্বন নিঃসরণের কারণেই অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা। আইপিসিসি’র তথ্য বলছে, প্রাক-শিল্পযুগের (১৮৫০-১৯০০) তুলনায় এখন পর্যন্ত পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েছে ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
গত মাসে প্রকাশিত আইপিসিসি’র ষষ্ঠ সমীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০৪০ সাল নাগাদ পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পযুগের (১৮৫০-১৯০০) তুলনায় ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে। ফলাফল, ২০ বছর পর পৃথিবীর অনেক জায়গায় ঘরের বাইরে গেলেই মানুষ গরমেই মারা যাবে। অন্যদিকে, তাপমাত্রা বাড়ায় মেরু ও পর্বতে সঞ্চিত বরফ গলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কার্বন নিঃসরণ কমানো এবং বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানো সম্ভব। আর, কার্বণ নিঃসরণ কমানোর উপায় হচ্ছে জীবশ্ম জ্বালানির (কয়লা, তেল, গ্যাস) পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করা। একইসাথে, গাছ যেহেতু কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে, তাই বন সংরক্ষণ ও নতুন বনায়নের মাধ্যমেও জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন করা সম্ভব।
বিশ্বের ১ নম্বর উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে ব্র্যাক একদিকে যেমন সমস্ত কর্মকাণ্ডে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয় যাচ্ছে, অন্যদিকে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির কলেবরও দিন দিন সম্প্রসারণ করছে।
এরই ধারাবাহিকতায় এইচএসবিসি ব্যাংকের অর্থায়নে চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরের ভাটিতে ফেনী নদীর মোহনায় নতুন সৃষ্ট ১০ একর ভূমিতে ম্যানগ্রোভ বনায়নের উদ্যোগ নিয়েছে ব্র্যাক জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচি।
গত ২৬শে আগস্ট ২০২১ তারিখ এই বনায়ন কর্মসূচির উদ্বোধন করা হয়। কেওড়া, বাইন, গেওয়া, গোরান এবং কাঁকরা এই ৫ প্রজাতির মোট ৪০ হাজার চারা রোপণ করা হবে। স্থানীয়ভাবে এ ধরনের বনকে বলা হয় প্যারাবন।
ক্রান্তীয় বনের চেয়ে ২ থেকে ৪ গুণ বেশি কার্বন শোষণ করে ম্যানগ্রোভ বন। অর্থাৎ উপকূলজুড়ে ম্যানগ্রোভ সম্প্রসারণ করা গেলে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনে তা মাইলফলক হবে। রোপিত গাছসমূহ কিছুটা বড়ো হলেই এখানে ম্যানগ্রোভ বা প্যারাবনের প্রতিবেশ তৈরি হবে, অন্যান্য ঘাস, লতা-পাতা জন্মাবে স্বাভাবিক নিয়মেই।
এই ম্যানগ্রোভ বন যে শুধু জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনে সহায়তা করবে তা নয়, এর মাধ্যমে সেখানে বন্য ও জলজ প্রাণীর আবাসনও তৈরি হবে। বিকাশ ঘটবে কাঁকড়া, চিংড়িসহ নানাবিধ জলজ সম্পদের। ম্যানগ্রোভ বা প্যারাবন চিংড়ি ও অন্যান্য সামুদ্রিক মাছের প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে। প্যারাবন সমুদ্রের উর্বরতা ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য বাড়ায়। যা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সহায়ক হবে। বিশেষ করে এই মহামারি কালে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে বৃক্ষরোপণের কাজে সম্পৃক্ত করায় তাদের জীবিকার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
ম্যানগ্রোভ গাছ যেহেতু অনেক ডালপালাযুক্ত, তাই ভবিষ্যতে এই বন জ্বালানি ও পশুখাদ্যের অন্যতম উৎসে পরিণত হবে। কেওড়া ফুল ও ফল থেকে কেওড়া জল ও আচার তৈরি কার যায়। নতুন এই বন স্থানীয়ভাবে মৌ চাষের সুযোগ তৈরি করবে। প্যারাবন তৈরি হলে স্থানীয় জেলেদের দুর্যোগ ঝুঁকি কমবে এবং সাগরে মাছ আহরণের পরিমাণ বাড়বে। আবাস মিলবে পশুপাখিরও।
ম্যানগ্রোভ বন ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের গতি কমায়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এক কিলোমিটার ম্যানগ্রোভ অতিক্রম করতে জলোচ্ছ্বাস তার ৭৫ শতাংশ গতি হারিয়ে ফেলে।
এই ম্যানগ্রোভ বন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরের বাঁধকে জলোচ্ছ্বাস ও জোয়ারের ঢেউ থেকে সুরক্ষা দেবে। একইসাথে শিল্পনগর থেকে নিঃসরিত কার্বন শোষণ করবে। এই বন সম্প্রসারণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর কার্বন নিউট্রাল হওয়ার পথে এগিয়ে যাবে।
অর্থাৎ, জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনে প্রকৃতি ভিত্তিক সমাধান শুধু প্রকৃতির জন্যই যে ভালো তা নয়, এর আর্থ-সামাজিক গুরুত্বও অনেক।
সম্পাদনা- তাজনীন সুলতানা



