ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ, নির্মূল ও সার্বিক উন্নয়ন

তারিখ: 26 এপ্রি. 2018

লেখক: শামীম হোসেন

বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলসহ অন্যান্য পাহাড়ী এলাকায় ম্যালেরিয়া এক সময় ছিল আতঙ্কের একটি নাম। কেননা, অতীতে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে এদেশের অনেক মানুষ দূর্ভাগ্যজনকভাবে, অকালে তাদের প্রাণ হারিয়েছে। এখনও দেশের ১৩টি জেলার ৭১টি উপজেলায় ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব রয়েছে। তবে বেশির ভাগ ম্যালেরিয়া রোগী মূলত পার্বত্য এলাকার তিনটি জেলায় রয়েছেন- বান্দরবান, রাঙামাটি এবং খাগড়াছড়ি। সীমান্তবর্তী পাহাড়, বেশি বৃষ্টিপাত, বনাঞ্চলবেষ্টিত হওয়া, অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, অশিক্ষা ও দারিদ্র্য, অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ইত্যাদি নানা কারণে এসব অঞ্চলের মানুষকে প্রতিনিয়ত লড়াই করে যেতে হচ্ছে প্রাণঘাতী এই রোগের সাথে। জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ২৯ হাজার ২৪৭ জন ম্যালেরিয়ায় রোগীর শতকরা ৯৩ জনই এই তিন জেলার।

জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচিতে সরকারের সঙ্গে ব্র্যাকসহ অন্যান্য এনজিও-র সমন্বয়ে গঠিত একটি কনসোর্টিয়াম যৌথ অংশীদারিত্বের মাধ্যমে কাজ করছে। অংশীদারত্বের কারনে যেখানে সরকারের প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাব রয়েছে, সেখানে মাঠপর্যায়ে এনজিও স্বাস্থ্যকর্মীরা রোগীর দ্বারপ্রান্তে চিকিৎসা সেবা পৌছে দিচ্ছে, এমনকি দূর্গম এলাকাগুলোতেও।

ব্র্যাকের নেতৃত্বে এনজিওগুলো মাঠ পর্যায়ে বিনামুল্যে দীর্ঘস্থায়ী কীটনাশকযুক্ত মশারি বিতরণ, ম্যালেরিয়া রোগ সনাক্তকরন ও চিকিৎসা সেবা প্রদান এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকারকে সহায়তা করছে। যার ফলে অতি দ্রুত রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে।

এখনও পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার (৩.২বিলিয়ন) প্রায় অর্ধেক এ রোগের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। বিশেষ করে আফ্রিকারসাব-সাহারা অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেশি। প্রতি বছর সারাবিশ্বে এ রোগে যত মানুষের প্রাণহানি ঘটে তার প্রায় ৯০ ভাগই এইসাব-সাহারা আফ্রিকা অঞ্চলে। গর্ভবতী নারীও পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার হার তুলনামূলক ভাবে বেশি। আফ্রিকায় ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি মিনিটে গড়ে একটি করে শিশু মারা যায়। দক্ষিণ এশিয়াতেও এ রোগের যথেষ্ট প্রার্দুভাব রয়েছে। তন্মধ্যে ভারত, ইন্দোনেশিয়া উল্লেখযোগ্য।

এনোফিলিস প্রজাতির স্ত্রী মশার মাধ্যমে ম্যালেরিয়া রোগ ছড়ায়। এ রোগের প্রধান লক্ষন জ্বর। জ্বর হলে বা ম্যালেরিয়া সন্দেহ হলে চিকিৎসার জন্য নিকটবর্তী বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের শরণাপন্ন হচ্ছেন। তাতে করে প্রত্যন্ত ও এলাকার দরিদ্র লোকজন সঠিক সময়ে এ রোগ সনাক্তকরণের পাশাপাশি চিকিৎসা সেবা নিয়ে দ্রুত সেরে উঠে তাদের প্রাত্যহিক কাজকর্মগুলো চালিয়ে নিতে পারছেন। এতে ভোগান্তি কমে যাচ্ছে। সর্বোপরি, ম্যালেরিয়া রোগীর পরিবারের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এসব কার্যক্রম বড় ভূমিকা পালন করছে। দীর্ঘদিন অসুস্থ্ হয়ে পড়ে থাকা, কাজ করতে না পারা এবং চিকিৎসা ব্যয় রোগীর পরিবারকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। পাহাড়ী, প্রত্যন্ত ও দুর্গম এলাকায় ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে এনজিওদের এসকল কার্যক্রম ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে কর্মক্ষম ও উপার্জনক্ষম রাখতে ভূমিকা পালন করছে।

তাছাড়া ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকাসমূহে সরকার ও এনজিওগুলোর যৌথ উদ্যোগে কমিউনিটি নির্ভর যেসব কার্যক্রম রয়েছে তা চালিয়ে নেয়া ও বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। শুধু বিদেশি সহায়তার উপর নির্ভর করে এসব অঞ্চলে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করা বিচক্ষণতার পরিচায়ক হবে না। ধীরে ধীরে নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি এসব অঞ্চলে বিভিন্ন কার্যক্রম ধারাবাহিকভাবে পরিচালনার জন্য অর্থায়নসহ সকল দায়-দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নেয়ার চেষ্টা করতে হবে। আর তাতে করেই দেশের ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী টেকসই উন্নয়নের একটি উদাহরণ হয়ে উঠতে পারবে।

২৫শে এপ্রিল ‘বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস-২০১৮’ উপলক্ষে ম্যালেরিয়া নির্মূলে ভবিষ্যৎ করণীয়, ঝুঁকি মোকাবেলায় চ্যালেঞ্জ, সুপারিশ এবং ম্যালেরিয়া সম্পর্কিত বার্তা মানুষের কাছে তুলে ধরতে জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচি ও ব্র্যাক যৌথভাবে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। ব্র্যাকের কমিউনিকেবল ডিজিজেস, ওয়াশ ও ডিএমসিসি কর্মসূচির পরিচালক ড. মো. আকরামুল ইসলাম এই সম্মেলনে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলিতে ব্র্যাকের ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচি সম্প্রসারণের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন।

ম্যালেরিয়া এবং এ ধরনের বিভিন্ন রোগ একটি সুন্দর পৃথিবী নির্মাণের পথে বাধা। আসুন, আজ সমস্বরে বলি, ‘ম্যালেরিয়া নির্মূলে প্রস্তুত আমরা’। সবার জন্য বাসযোগ্য এক পৃথিবী গড়তে চলুন সকলে মিলে একযোগে এই রোগ নির্মূলে ঝাঁপিয়ে পড়ি।

3.3 3 votes
ব্লগটি কেমন লেগেছে?