মিনি পুকুর : পুষ্টি ও আয়ের এক নতুন সম্ভাবনা

তারিখ: 28 নভে. 2024

লেখক: কানিজ ফাতেমা-তুজ-জহুরা

“মাছ চাষ করতি পারব কখনও ভাবি নাই, কিন্ত এখন আমি আমার ঘরের আঙিনাত মাছ চাষ করতি পারতিছি। এমনকি পাশের ঘর থাইকে প্রতিবেশীরাও অনেক সময় মাছ কিনতি আসে। এখন আমি আমার বাচ্চাদের পাতে প্রায় প্রত্যেকদিন মাছ দিতি পারি। বিকাল হলি পরে ওরাও আমার লগে মাছেরে খাবার দিয়া আনন্দ পায়।”

বিউটি আকতারের এই কথা যেন একটি সফল উদ্যোগের পাশাপাশি তার জীবনের ভালো সময়ের কথাও বলে। যশোরের কেশবপুরের ছোট্ট বাড়িতে স্বামী, সন্তান এবং শাশুড়িসহ থাকেন তিনি। গ্রামের সাধারণ গৃহবধূ থেকে কীভাবে ধীরে ধীরে একজন সফল উদ্যোক্তা হয়ে উঠলেন, আমরা সে গল্পটাই শুনছিলাম তার কাছ থেকে।

বিউটি আপার স্বামী কৃষিকাজ করেন। কিন্তু শুধু চাষাবাদে আর চলছিল না। সংসারে কত খরচ! দিনদিন বাজার খরচ বেড়েই যাচ্ছিল। আগে ঘরে চাল থাকলে ভাবনা ছিল না, খাল-বিলে মাছ, খেতে সবজি পাওয়াই যেত। মাছের দামও কম ছিল। কিন্তু এখন এমনও দিন যাচ্ছিল যে কখনও কখনও শুধু সবজি দিয়েই খাওয়াদাওয়া সারতে হতো। কিন্তু তিনি জানতেন মাছ-মাংস ছেলেমেয়েদের বড় হয়ে ওঠার সময় খুব দরকার।

‘মাছে ভাতে বাঙালি’—এই প্রবাদটি সবার কাছে পরিচিত হলেও বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, যেমন বন্যা, খরা, তাপদাহ ও শৈত্যপ্রবাহ, মাছের উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক এবং চাষের মাছ উভয় উৎসের উৎপাদনই বিঘ্নিত হচ্ছে। এর ফলে বাজারে মাছের ঘাটতি তৈরি হয়েছে এবং দামও বেড়েছে।

বিউটি আপা একদিন পাশের বাড়িতে ব্র্যাকের ভ্রাম্যমাণ এডাপটেশন ক্লিনিকের মাধ্যমে জলবায়ু সহনশীল কৃষি প্রযুক্তি এবং মাছ চাষ সম্পর্কে জানতে পারেন। আঙিনাতেও আধুনিক নিয়মে পুকুর কাটা যায়। জায়গাও বেশি লাগে না, খরচও কম। স্বামীর সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নিতে তাই আর দেরি করেননি।

স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে জলবায়ু সহনশীল কৃষি প্রযুক্তি এবং মাছ চাষ সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছেন ব্র্যাকের কৃষি ডাক্তার

মিনি পুকুরে মাছ চাষের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা ও আয়ের উৎস তৈরি করা সম্ভব। ব্র্যাক এডাপটেশন ক্লিনিক কৃষকদের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার প্রশিক্ষণ দেয়, আবার তাদের জন্য উপযুক্ত প্রযুক্তি এবং চাষাবাদ পদ্ধতি শেখায়। অংশগ্রহণকারীদের প্রদান করে এলাকাভিত্তিক প্রশিক্ষণ।

মোবাইল এডাপটেশন ক্লিনিকের সঙ্গে বিউটি আপা যোগাযোগ করেন এবং তার সদস্য হন। এরপর কিছুদিনের মধ্যে ব্র্যাক থেকে একজন কর্মী বিউটি আপার বাসায় যান। তারা তাকে হাতেকলমে সঠিকভাবে পুকুর তৈরির পদ্ধতি শেখান।

এই মিনি পুকুরটি ১৮ ফুট দীর্ঘ, ৩.৫ ফুট প্রশস্ত ও ৩.৫ ফুট গভীর। পুকুরের ভেতরে পলিথিন শিট দিয়ে  পুরোটা আচ্ছাদিত করে নেন। পুকুরের চারপাশে জাল দিয়ে ঘিরে দেন যেন অন্য কোনো পাখি বা প্রাণী পুকুরের মাছ খেতে না পারে।  এরপর পুকুরটি পানি দিয়ে পূর্ণ করেন। পানির সঙ্গে চুন ও লবণ মেশান। এভাবে মাছ চাষের জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত করা হয় পুকুর।

ব্র্যাক এডাপটেশন ক্লিনিকের সহযোগিতায় বিউটি আপা মিনি পুকুরে মাছের পোনা ছাড়ছেন

ব্র্যাক এডাপটেশন ক্লিনিক থেকে কর্মী এসে প্রথমে পরীক্ষা করে দেখেন পুকুর মাছ চাষের উপযুক্ত হয়েছে কি না। তারপর প্রায় ৩ হাজার কৈ মাছের পোনা দেওয়া হয় বিউটি আপাকে। এরপর প্রতিদিন সকাল-বিকাল চলে যত্ন নেওয়ার পালা। মিনি পুকুরে মাছের খাবার দিতে হয়, সময় সময় পানি পাল্টাতে হয়। দু-এক মাস পরে মাছ একটু বড় হলে তারা একটা-দুটো করে ধরে খাওয়া শুরু করেন।

কিছুদিন পরে সব মাছ একসঙ্গে বড় হয়ে গেল। এবার বিক্রির কথা চিন্তা করলেন। প্রায় তিন মাস পর দেখা গেল তারা নিজেরা খাওয়ার পরও প্রায় ৩০ কেজি কৈ মাছ ৩শ টাকা দরে মোট ৯ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন।

বাড়ির আঙিনায় পুকুর, কাজেই দেখাশোনার জন্য খাটুনি কম। এখন তো তার ছেলেমেয়েরাও মাছের খাবার তৈরি করতে এবং তা দিতে শিখে গেছে। ঠিক করেছেন পরের মাসে আবার মাছ ছাড়বেন তিনি। এছাড়া পুকুরের আশেপাশে সবজির বাগান করা যায় কি না তা নিয়েও মোবাইল এডাপটেশন ক্লনিকের সঙ্গে কথা বলবেন।

ছোট পরিসরে মিনি পুকুর মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কৈ, মাগুর, শিং—এই ধরনের মাছগুলো সাধারণত যেকোনো জলাশয়ে খাপ খাওয়াতে পারে। এছাড়া বছরে তিনটি পৃথক সাইকেলে এ মাছ চাষ করা যায় বলে এখানে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি কম।  বাড়ির পাশে অবস্থিত হওয়ায় পরিবারের মহিলারা খুব সহজেই এটির দেখভাল করতে পারেন। এছাড়া ও পুকুরের পানি ব্যবহার হরে  বাড়ির আশেপাশে সবজি চাষ করাও সম্ভব।

বিক্রির জন্য ধরা হয়েছে মাছ

সবার বড় পুকুর খনন করার মতো সুযোগ ও সামর্থ্য থাকে না। বাড়ির আঙিনায় মিনি পুকুরে যদি মাছ চাষ করা যায় তাহলে সেখান থেকে অর্থ ও পুষ্টি দুটোই নিশ্চিত করা যায়। পুকুর ও অন্যান্য জলাশয় বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও, বসতবাড়ি একটু  উঁচু জায়গায় হওয়ায় এখানে মাছ চাষে ঝুঁকি কম। পাশাপাশি অল্প বিনিয়োগে তিনটি সাইকেল-এ ভিন্ন ধরনের (কৈ, মাগুর, শিং) মাছ চাষ করে মানুষের জীবিকায়নের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। নারীদের জন্য মিনি পুকুরে মাছ চাষ বাড়তি আয়ের উৎস হতে পারে।

বিউটি আপা তো খুব খুশি। পরিবারের স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং বাড়তি আয় দুই-ই হচ্ছে। তবে তিনি মনে করেন পরিবারের কথা ভেবে শুরু করলেও এ কাজ ছাড়বেন না। তিনি নিজেকে একজন সফল উদ্যোক্তা বলতেই ভালোবাসেন।

5 1 vote
ব্লগটি কেমন লেগেছে?