মোনালিসার কপালে নীল টিপ

তারিখ: 28 ডিসে. 2023

লেখক: সাব্বির আহমেদ ইমন

কিশোরগঞ্জের বাহাদিয়া গ্রাম। প্রধান সড়ক ধরে কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর হাতের ডানে পড়ে কাঁচা রাস্তা। রাস্তার দুপাশে সারি সারি গাছ। মাঝে মাঝে ভেসে আসছে পাখিদের কিচিরমিচির। একটু সামনে এগোলেই পুকুর পাড়। ভর দুপুরে দু-তিনজন পুকুর পাড়ে মাচায় বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। মৃদুমন্দ বাতাস ঘর্মাক্ত শরীরে দিচ্ছে শীতল অনুভূতি। আর সাথে চলছে আড্ডা।

খানিকটা মেঠোপথ পেরিয়ে আমরা একটি বাড়ির উঠোনে এসে উপস্থিত হলাম। কমলা রঙের চটের ওপর ‘ইউ’ আকৃতিতে বসে আছে একদল কিশোরী। সংখ্যায় তারা ২০-২৫ জন হবে। প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে তারা সবাই নাম উঠিয়েছে হাইস্কুলের খাতায়। সমবয়সী, সবাই এ গ্রামেরই।

তারা ‘স্বপ্নসারথি’। তাদের মধ্যে গড়ে ওঠা বন্ধুত্বটা চোখে পড়ার মতো। সবার যে আগে থেকে পরিচয় ছিল এমন নয়। তারা এখানে একসঙ্গে সেশন করতে এসে নিজেদের মধ্যে একটা নিবিড় সখ্যতা গড়ে তুলেছে।

তখনও ব্র্যাকের ভাই সেশন শুরু করেননি। তাই চটে বসে নিচু গলায় কিশোরীরা নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করছিল – আজ স্কুলে কী মজার ঘটনা ঘটেছে, ক্লাসের বিরতিতে লুকোচুরি খেলার সময় কে কতবার চোর হয়েছে, একটু পরে তাদের জন্য কোন খেলা থাকতে পারে – এমন কত কথা!

এ নিয়ে তাদের দ্বিতীয়বার একসঙ্গে জড়ো হওয়া। গল্প আর খেলায় তাদের প্রতি মাসে এই একটা দিন বেশ কাটে।

স্বপ্নসারথিদের সঙ্গে সেশনে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে

বাল্যবিয়ের হার কমানোর লক্ষ্যে ২০২৩ সালে বাংলাদেশের ৩১টি জেলার প্রায় ৫৮ হাজার কিশোরীদের নিয়ে ব্র্যাক গঠন করেছে ‘স্বপ্নসারথি’ দল। বাল্যবিয়ের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানানোর পাশাপাশি  পড়ালেখা করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাধ্যমে কীভাবে তারা নিজের পরিবার ও দেশের সেবা করতে পারে সে বিষয়ে তাদের সচেতন করা হয়। খেলার মাধ্যমে শেখানো হয় দলগত কাজ, নেতৃত্ব, পাবলিক স্পিকিং-এর মতো জীবন দক্ষতার নানা কৌশল। এতে তাদের মনোবল বাড়ছে, তারা অধিকার আদায়ে হয়ে উঠছে আগের চেয়ে আরও বেশি সচেতন। স্বপ্নসারথিদের জন্য দুই বছর ধরে ২৪টি সেশনে চলবে এ কার্যক্রম।

অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটল। শুরু হলোে আজকের সেশন। সেশন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ব্র্যাকের ভাই কুশলাদি বিনিময়ের পর তাদের কাছে আগের ক্লাসে শেখা বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে চাইলেন। তারপর বললেন, “আজকের সেশনের মজার খেলা মোনালিসার কপালে টিপ পরানো।”

বিখ্যাত চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির অমর চিত্রকর্ম ‘মোনালিসা’র একটি ছবি বের করে তিনি আঠা দিয়ে দেয়ালে লাগিয়ে দিলেন। এরপর কিশোরীদেরকে কয়েকটি দলে ভাগ করলেন। আর তাদের মধ্যে একা একজনকে নির্বাচন করলেন, তার দলে আর কেউ নেই।

প্রতিটি দলকেই একে একে মোনালিসার কপালে টিপ পরাতে হবে। তবে সেটা করতে হবে চোখ বাঁধা অবস্থায়। একটু দূর থেকে থেকে সেই দলের একজন বলবে কীভাবে সামনে এগোলে কপালে টিপ পরানো যাবে।

খেলার সময় একজন অন্যজনের চোখ বেঁধে দিচ্ছে

শুরু হলো মোনালিসার কপালে টিপ পরানোর খেলা।

চোখ বাঁধা অবস্থায় একজন টিপ হাতে এগিয়ে যাচ্ছে মোনালিসার ছবির দিকে। আর একটু দূরে দাঁড়িয়ে সেই দলেরই একজন বলছে–

“সোজা…সোজা……আরেকটু ডানে…হ্যাঁ সোজা… এবার একটু উপরে……একটু নিচে…”

নির্দেশনা ঠিক বুঝতে না পেরে করে কেউ মোনালিসার মুখে টিপ পরিয়ে দিচ্ছে, তো কেউ আবার নাকের ডগায়। এসব দেখে হাসির রোল পড়ে যায় চারদিকে। ওদিকে দলগুলোর মধ্যে কাজ করছে চাপা উত্তেজনা। খেলায় জিততে হলে যে কম সময়ের মধ্যে মোনালিসার কপালে টিপ পরাতে হবে!

পাশের জনের কথা শুনে মোনালিসার কপালে টিপ পরানোর চেষ্টা

কেউ যদি ঠিকঠিক মোনালিসার কপালে টিপ পরাতে পারে তাহলে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে মেতে উঠছে সবাই। খেলা জমে উঠেছে।

এবার সবশেষ জনের পালা, যার দলে আর কেউ নেই। তার বেলায় নিয়মটা অন্যদের চাইতে একটু আলাদা।

গামছা দিয়ে তার চোখ বেঁধে দেওয়া হয়। এবার তাকে কেউ “সোজা…সোজা……আরেকটু ডানে…” এমন বলে সঠিক পথের নির্দেশনা দেবে না। বরং নানাভাবে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবে। দেখা গেল, সবার কথায় বিভ্রান্ত হয়ে সে মোনালিসার ছবির কাছেও পৌঁছোতে পারল না।

প্রশিক্ষক সবাইকে জিজ্ঞেস করল, তারা কী শিখল।

সবাই বেশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলল, “একসঙ্গে মিলেমিশে কাজ করলে একটা উপায় হয়ই হয়। যেকোনো কঠিন কাজও সহজ হয়ে যায়।”

সেদিনের মতো সেশন শেষ হয়। সবাই বাড়ির পথ ধরেছে। আমি এক ফাঁকে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলি। তাদের স্বপ্ন সম্পর্কে জানতে চাই।

তাদের কেউ শিক্ষক হতে চায়, তো কেউ আইনজীবী। আবার কারো স্বপ্ন বড় হয়ে ডাক্তার হওয়ার। একেকজনের স্বপ্ন একেক রকম হলেও তাদের সবার মধ্যে একটা ব্যাপারে বেশ মিল ছিল। তারা প্রত্যেকেই পড়ালেখা করে স্বাবলম্বী হতে চায়, পরিবারের জন্য, আপনজনদের জন্য এবং নিজে ভালো থাকার জন্য। তারা স্বপ্ন দেখে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর।

মায়ের সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল এক স্বপ্নসারথি

আমি কয়েকজন স্বপ্নসারথির মায়ের সঙ্গেও কথা বলেছিলাম। মেয়েদের সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য যতদূর সম্ভব পড়ালেখা করাতে চান তারা। অল্পবয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়া মায়েরা তো আরও সচেতন। নিজেদের মতো ভুল যেন আর না হয় সেজন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আলাপচারিতায় এটাও স্পষ্ট হলো যে, ছেলেমেয়েদের যেন আলাদা চোখে দেখা না হয় সে চেষ্টাও তারা করছেন।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। এবার ফেরার পালা। কিশোরগঞ্জ থেকে ফেরার পথে বারবার ভাবছিলাম সেই প্রাণোচ্ছল কিশোরীদের কথা – যাদের চোখে খেলা করছে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। তারা স্বপ্নসারথি। মনে হলো, আমাদের স্বপ্নগুলোও পূর্ণতা পাবে স্বপ্নসারথিদের হাত ধরেই।

4.7 3 votes
ব্লগটি কেমন লেগেছে?