মনের যত্নে মন দিয়ে শোনাও জরুরি

তারিখ: 12 সেপ্টে. 2024

লেখক: সাদিকুর রহমান হিমু

যে ঘরের প্রতিটি কোন চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়, বন্যার পর সেই ঘরে ফিরে তারা দেখছে হাঁটু সমান কাদা। যা রেখে গিয়েছিল, বেশিরভাগই আর ব্যবহারের উপযোগী নেই। তিল তিল করে গড়ে তোলা সংসারের এই হাল দেখার ধাক্কা সামলে ওঠা এত সহজ নয়। ভয়, শঙ্কা আর অনিশ্চয়তার রেখা তাদের চোখেমুখে স্পষ্ট।

বন্যা শুরুর পরপরই আমরা কয়েকজন দুর্গত এলাকায় চলে যাই। এরপর সপ্তাহখানেক ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানে কাটিয়েছি। প্রথম দু-একদিন দেখলাম পানি হুহু করে বাড়ছে। তেমনি পানি কমতে শুরু করাও আমরা কাছ থেকে দেখলাম। সবমিলিয়ে মনে হলো, মানুষের যা কিছু সম্বল তা নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া আবার পানি কমলে নিজ বাড়িতে ফিরে আসা—দুটোই দুরকম সংগ্রাম।

বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর শুরু হয় বেঁচে থাকার নতুন সংগ্রাম

ফেনী শহর থেকে একটু ভেতরের দিকে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। বন্যার পানি তখন অনেকটা নেমে গেছে। রাস্তার পাশে কিছু টং দোকান খোলা দেখে ভাবলাম হয়তো চা পাওয়া যেতে পারে। একটু এগিয়ে যাওয়ার পর দেখলাম দোকানিরা পানিতে ভেজা ও নষ্ট হয়ে যাওয়া মালপত্র বের করতে ব্যস্ত। দোকানের মধ্যে তখনও সবকিছু ভেজা-স্যাঁতসেঁতে। বেচাবিক্রি চলছে না। ক্রেতাও নেই।

আমরা দোকানের অবস্থা দেখেই বুঝলাম এখানে চা পাওয়া যাবে না। আবার হাঁটতে শুরু করলাম। পানি নেমে গেলেও আশেপাশের ঝোপঝাড়ে কাদা লেগে আছে। মোড় ঘুরে আরেকটি টং দোকানে দেখলাম কিছু মানুষের জটলা। এখানে চা পাওয়া যাবে। কাজেই ভিড় ঠেলে এগিয়ে অন্যদের মতো আমরাও চায়ের অর্ডার দিলাম। মামা, চারটা রং চা। চা-বিক্রেতা গরম পানিতে হালকা লিকার ঢেলে চা বানিয়ে দিলেন।

ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। সেজন্য কিছু শুকনো খাবার সঙ্গে রাখা ভালো ভেবে পাশের মুদি দোকানে হানা দিলাম। কয়েক প্যাকেট বিস্কুট, ড্রাই কেক আর পানি কেনা হলো। দেখলাম, বন্যার কারণে যাতায়াত খরচ বেড়ে যাওয়ার কথা বললেও তিনি প্যাকেটের গায়ে লেখা দামই রাখলেন।

আমাদের মধ্যেই একজন দোকানদারের কাছ থেকে খাবারের ব্যাগ বুঝে নিতে নিতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মেয়াদ আছে তো?’ জবাবে ‘হ্যাঁ’ বলে দিলেই হতো। কিন্তু তিনি খানিকটা বিরক্ত হয়ে রাগত স্বরে বললেন, ‘ভাই, কষ্ট করি ভালা জিনিস লই আইলাম, তাও আন্নেগো মন হাইলাম না।’

আমরা বুঝলাম, মন খারাপ আছে তার। ‘ভাই কিছু মনে কইরেন না। কেনার সময় আমরা জিজ্ঞেস করে নেই আরকি!’ একথা বলে সেখান থেকে চলে আসলাম।

তার মন খারাপ চেহারাটা দাগ কেটে রইল। সেই দোকানি ভাইয়ের মতো কেউ হয়তো ঘরবাড়ি সব হারিয়ে দিশেহারা, আবার কেউ হয়তো নিজের আয়ের শেষ উৎসটাও খুইয়েছেন। ভয়, শঙ্কা, উদ্বেগের কারণে একেকজনকে একেকরকম আচরণ করতে দেখা যাচ্ছে। কেউ মেজাজ হারাচ্ছেন, কেউ ভয়ে চুপচাপ।

সহকর্মী পলিন আমার সঙ্গেই ছিল। সে বলল, এই তো সেদিন স্কুলে আশ্রয় নেওয়া এক মা আর ছেলেকে দেখলাম। ছেলেটা ‘ভাত খাব’ বলে বায়না ধরেছিল। কিন্তু মা তাকে বারবার শুকনো খাবার সাধছিলেন। পরে সেই মা আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘হোলা ভাত খাইতো চাইসে, মা হই দিতাম হারি নো। এরতুন কষ্টের আর কী হইতে ফারে?’

বন্যার আগে তাদের সুন্দর একটা ঘর ছিল। সেই ঘরটা এখন শুধুই টিনের চারটে বেড়া। দাঁড়িয়ে আছে কোনোমতে।’

জরুরি সহায়তার পাশাপাশি এখন দরকার সহমর্মিতার। আমাদেরকে তাদের পাশে থাকতে হবে। তাদের মানসিক সাপোর্টটাও এই মুহূর্তে অনেক বেশি প্রয়োজন। কয়েকদিন আগে শুনেছিলাম, বন্যা আক্রান্ত কুমিল্লার চান্দিনা, পালপাড়াসহ কয়েকটি কেন্দ্রে ব্র্যাক জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে মনোসামাজিক সহায়তা পৌঁছে দিতে কাজ করছে।

বন্যাদুর্গতেদের জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছেন ব্র্যাককর্মী

ফারজানা শারমিন মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছেন ব্র্যাক স্বাস্থ্য কর্মসূচিতে। ফিরে এসে আমরা আপার সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তিনি কুমিল্লায় গিয়েছিলেন কিছুদিন আগেই। কথা বলতে বলতে জানতে চাইলাম, ‘কী দেখে আসলেন সেখানে?’

ফারজানা আপা বললেন, ‘কী বলব! পানি নেমে যাওয়ার পরে চারিদিকে এত ক্ষয়ক্ষতি দেখে মানুষ হতভম্ব। অন্যকে সান্ত্বনা দেবে কি, নিজের ঘরেই তো কিছু নেই। তাদের এই অবস্থা দেখে একটা কথাই মনে হয়েছে, আগে তাদের কথাগুলো শোনা উচিৎ। কষ্টের কথা বলতে পারলেও মনের ভার কিছুটা কমবে। সেজন্য আমরা টিমের সবাই সেখানে যতদিন ছিলাম, বেশিরভাগ সময় মানুষের কথা শুনেছি। কথা বলে তারা মন হালকা করেছে। তারপর দরকার মতো কাউন্সেলিং সেবা দিয়েছি।’

আপার সঙ্গে আলাপচারিতার সময় সেই দোকানদারের কথা মনে পড়ল। তার দোকানের কত মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে! তিনি কিন্তু আবার দোকান সাজিয়ে বসেছেন। সবাই হয়তো এভাবেই ঘুরে দাঁড়াবে।

দুর্যোগ যত বড়ই হোক না কেন, তাকে মোকাবিলা করতে মনের সাহসই শক্তি জোগায়।

5 1 vote
ব্লগটি কেমন লেগেছে?