মশিউর (ছদ্মনাম) জেলা শহরে থাকেন। তিনি একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার আঞ্চলিক কর্মকর্তা। স্ত্রী, দুই মেয়ে এবং মা-বাবাকে নিয়ে ভালোই আছেন। তাদের পরিবারে খুব সাধারণ একটি দৃশ্য হলো, তিনি বাসায় ফিরে আবার অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আর সত্যি বলতে, তিনি তা করতেও ভালোবাসেন। এটা তো স্বাভাবিক যে, কাজের সময় অন্য কেউ কথা বলতে থাকলে বিরক্ত লাগে। এমনটা প্রায়ই হতো যে, বাসায় বসে কাজ করার সময় কেউ ঘরে ঢুকে কথা বললেই সে তাদের কথা শুনত না, বরং ‘পরে হবে’ বলে চলে যেতে বলত। একদিন-দুদিন করতে করতে মশিউর ভাইয়ের এটাই স্বভাব হয়ে গেল। সবাই মোটামুটি জেনে গেল তার সাথে সব কথা বলা যায় না।
হঠাৎ একদিন মশিউর ভাইয়ের মনে হলো বাসায় তিনি খুব একা। কাজের ফাঁকে তিনি যখন মেয়ে বা মা-বাবার সাথে কথা বলতে যান, তখন এই ‘কেমন আছো, ভালো আছি’ এমন কুশল বিনিময় ছাড়া কথা খুঁজে পান না। অন্যরাও কিছু বলে না, দু-এক কথা বলে চুপ হয়ে যায়। স্ত্রীর সাথে সংসার খরচ বাদে বাড়তি কথা বলতে গেলে তো তিনি বিরক্তই হন। আরও খেয়াল করে দেখেছেন, এটা শুধু তার সাথেই ঘটে। পরিবারের অন্যরা বেশ আছে, একে অন্যের সাথে কথা বলে; খুনসুটি, হাসাহাসি সবই চলে। অফিসেও একই অবস্থা। শুধুমাত্র কাজের প্রয়োজনে সবাই তার সাথে যোগাযোগ করে। ইদানীং এই একা বোধের কারণে তিনি বড্ড হাঁপিয়ে উঠেছেন। মাঝে মাঝে সবার ওপর অভিমান হয়।
বাংলাদেশের সর্বশেষ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৮-১৯ অনুসারে প্রাপ্তবয়স্ক প্রায় ১৭ শতাংশ মানুষ মানসিক অসুস্থতায় ভুগছেন। শহরে এই হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। উদ্বেগজনিত অসুস্থতা প্রায় ৫ শতাংশ এবং বিষণ্নতাজনিত অসুস্থতা প্রায় ৭ শতাংশ। চিকিৎসাসেবার বাইরে রয়েছে ৯২ শতাংশ মানুষ।
মানসিক অসুস্থতা জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। শিশু, বৃদ্ধ, নারী ও পুরুষ—যেকোনো বয়সের মানুষই মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এডিএইচডি (শৈশবের নিউরোডেভেলপমেন্টাল ব্যাধিগুলোর মধ্যে একটি), দুশ্চিন্তা, উদ্বিগ্নতা, অটিজম, মাদক ব্যবহার, বাইপোলার ডিজঅর্ডার, কনডাক্ট ডিজঅর্ডার, হতাশা, বিষণ্নতা, খাওয়ার ব্যাধি বা ইটিং ডিজঅর্ডার, বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতা, আচরণ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা, সিজোফ্রেনিয়া ইত্যাদি সবই মনের অসুখ।
আমরা কীভাবে মানসিক চাপের সঙ্গে মানিয়ে নেব, অন্যদের সঙ্গে মিশব এবং সুস্থ জীবন যাপন করব—সবকিছুতেই মানসিক স্বাস্থ্য প্রভাব বিস্তার করে। মন খুলে কষ্টের কথা বলতে না পারলে দেখা যায় সে মানুষটি সমাধানের পথ খুঁজে না পেয়ে আরও জটিল সমস্যার মুখোমুখি হয়। এতে তার জীবনশক্তি কমতে থাকে, কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে আর শেষে দেখা যায় দুশ্চিন্তা, অনিদ্রা এমন নানা উপসর্গ জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে।
মশিউর ভাইয়ের এমনটাই হয়েছিল। তার মন খারাপ দিনে দিনে বাড়তেই লাগল। কিছুদিন ধরে তিনি কাজের প্রতিও আগ্রহ বোধ করছেন না। বাসায় কাজ নিয়ে গেলেও আর তা করতে ইচ্ছে করছে না। ছুটি নিতেও বিরক্ত লাগে। তিনি বিষয়টিকে গুরুত্ব দিলেন। অফিসের মানবসম্পদ বিভাগের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী এক ভাইকে সব খুলে বললেন। কাউন্সেলার ভাই সব শুনে বলেছিলেন, মন ভালো রাখতে মানতে হবে এই নিয়মগুলো-
- নিজেকে সময় দিন
- ভালো লাগে এমন কাজ করুন
- মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে নিজের দক্ষতা বাড়ান
- মনের কথা খুলে বলুন, নিজের ভালো লাগা, মন্দ লাগা সম্পর্কে জানুন
আমি, আপনি, আমাদের সবার মন ভালো রাখতে আসলে ওপরের কথাগুলো মেনে চলা ভালো। যদি কখনও মনে হয়, নিজের কথা কাউকে বললে ভালো লাগবে, তবে এমন কাউকে বলুন যে আপনার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবে, পাশে থাকবে, দোষ না ধরে মতামত জানাবে।
এ তো গেল আপনি যখন অন্য কাউকে নিজের কথা বলতে চান তার কথা। কিন্তু এমনও হয় যখন আপনি অপরের মনের কথা শুনছেন। তখন অবশ্যই খেয়াল রাখবেন, অন্যের চিন্তা বা অনুভূতি প্রকাশের সময় বাধা না দিয়ে তার কথা আগে শুনতে হবে, প্রয়োজনে পরে প্রশ্ন করে নিজের ধারণা স্পষ্ট করে নিতে হবে।
মনের কথা জমিয়ে না রেখে আপন কাউকে বলুন। এতে আপনি ভালো থাকবেন। আবার অন্যকেও মনের কথা বলার সুযোগ করে দেবেন। আসুন সবাই মিলে ভালো থাকি।



