একটি মাইকিং-
“সম্মানিত এলাকাবাসী, একখান জরুরি গোষণা। ব্র্যাক অর স্বাস্থ্যকর্মীঅল গরে গরে যাইয়েরে রুগী শনাক্ত গরের ও তারারে সহায়তা দিবার লাই হাজ গরের। অনে যদি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত অন ক্যান গরি গরত বইয়েরে সেবা লই সুস্থ অইত ফারন তারা আনর গত যাইয়েরে এই বিষয়ে ফরামর্শ দের।”
এটি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মানুষ এই ভাষায় কথা বলে। শুদ্ধভাবে বলতে গেলে বলতে হবে, “সম্মানিত এলাকাবাসী, একটি জরুরি ঘোষণা। ব্র্যাকের স্বাস্থ্যকর্মীগণ ঘরে ঘরে গিয়ে রোগী শনাক্ত করছে ও তাদের সহায়তা দেয়ার জন্য কাজ করছে। আপনি যদি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন, কীভাবে ঘরে বসে সুস্থ হতে পারেন তারা আপনার বাসায় গিয়ে এই বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন।”
একটু খটকা লাগল কি? এমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের জন্য মাইকিং কেন আঞ্চলিক ভাষায় করা হলো? আমরা সাধারণত শুদ্ধ বাংলার চর্চা করি, তবে কেন এই উদ্যোগ?
উন্নয়ন সংস্থাগুলো কাজ করে মূলত মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে। সঠিক তথ্য ও সেবা দিয়ে মানুষের পাশে আছে তারা। কিন্তু গ্রামবাংলার প্রতিটি প্রান্তে যারা থাকেন তাদের যদি কিছু বলতে চাই, কিছু জানাতে চাই তাহলে সে ভাষা কেমন হবে? সাধারণত আঞ্চলিক ভাষাতেই তো কথা বলে গ্রামের মানুষ। শুদ্ধ ভাষা তো তাদের কাছে বইয়ের ভাষা। এ তো অনেক সময় বুঝে ওঠাই দায়।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পৌঁছে দিতে আমরা সাধারণত নানা উপায় অবলম্বন করি, যেমন-লিফলেট, স্টিকার বিলি, মাইকিং ইত্যাদি। এর ভাষা থাকে শুদ্ধ বাংলা, যা অনেক সময় অনেকের কাছে তা সহজবোধ্য নয়। কিন্তু এই একই তথ্য যদি আঞ্চলিক তথা যে ভাষায় তারা কথা বলে সে ভাষায় বলা হয় বা লেখা হয়, তাহলে হয়তো তা অধিক কার্যকর হবে বলে আশা করা যায় এবং এতে তথ্য প্রদানের মূল উদ্দেশ্য সফল হবে।
ভাষা আমাদের চিন্তাকে প্রভাবিত করে। ইয়েল ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা যায়, ভাষা আমাদের আচরণকে অনেকাংশে প্রভাবিত করে। স্বাস্থ্যজনিত অভ্যাস, এমনকি অর্থনৈতিক অভ্যাস যেমন সঞ্চয়ের ও খরচের প্রবণতাও এর দ্বারা প্রভাবিত হয়। ২০১৯ সালে একদল গবেষক “আচরণগত পরিবর্তনে ভাষার প্রয়োজনীয়তা” শিরোনামে আমেরিকান জার্নাল অব লাইফস্টাইলে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। সেখানে তারা বলেছেন, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী কীভাবে এবং কী ভাষায় রোগীর সাথে কথা বলছেন তা রোগীর জীবনধারা ও আচরণে দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারে।

কাওসার (৩৫), পেশায় মুদি ব্যবসায়ী। রামুতে তার দোকান রয়েছে। আঞ্চলিক ভাষায় বার্তা প্রদানের উদ্যোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, “আগে যখন শুদ্ধ ভাষায় বাজারে মাইকিং করা হতো, তখন তার বেশিরভাগই বুঝতে পারতাম না। এখন আমাদের ভাষায় বলা হয়। শুনতে ভালো লাগে, বুঝতেও পারি আবার মনে রাখাও সহজ।”
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যখন ঊর্ধ্বমুখী তখন সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত সচেতনা বৃদ্ধির জন্য ইউএনফপিএ এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সহায়তায় ব্র্যাকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা কর্মসূচি (এইচএনপিপি) সিএসটি (কমিউনিটি সাপোর্ট টিম) নামে একটি প্রজেক্ট শুরু করে। এর আওতায় সাধারণ মানুষের কাছে সচেতনতামূলক বার্তা পৌঁছে দিতে কক্সবাজারের ৬টি উপজেলায় প্রচলিত ভাষায় (চাটগাইয়া) করোনা প্রতিরোধে সচেতনতামূলক বার্তা মাইকিং করা হয়। সাধারণত যে স্থানগুলোতে মানুষের সমাগম বেশি যেমন, বাজার; সেই এলাকাগুলো চিহ্নিত করে আঞ্চলিক ভাষায় মাইকিং কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
আমাদের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা (এইচএনপিপি) কর্মসূচি এই প্রথম আঞ্চলিক ভাষায় করোনা বিষয়ক সচেতনতামূলক বার্তা প্রচার করে। এর আগে যত মাইকিং করা হয়েছে, তাতে মূলত শুদ্ধ বাংলা ব্যবহার করা হয়েছিল যা গ্রামাঞ্চলের অনেকের বুঝতে অসুবিধা হতো। কক্সবাজার এলাকার বেশিরভাগ মানুষ আঞ্চলিক বা চাটগাইয়া ভাষায় কথা বলে। তাই, তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে ভাষা যেন বাধা না হয়ে দাঁড়ায় সেটাই ছিল এই উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য।
ভাষা মানুষের জন্মগত অধিকার। সামাজিক পরিবর্তন ও উন্নয়নের মাধ্যম হিসেবেও ভাষা কাজ করে। একটি সমাজে আচরণগত ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে চাইলে, সবার কাছে বার্তা পৌঁছতে চাইলে ভাষা হতে হবে সহজ ও বোধগম্য। সেকারণেই বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে আমাদের আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার ও চর্চা বাড়ানো দরকার।
সম্পাদনা- তাজনীন সুলতানা



