বাংলা ফন্ট ও টাইপিং : কর্মজীবনের একাল-সেকাল

তারিখ: 16 জুল. 2024

লেখক: প্রদীপ কুমার সাহা

সময়টা ছিল ১৯৮৯ সাল। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে প্রায়ই অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকত বিশ্ববিদ্যালয়। এমন পরিস্থিতিতে চারবন্ধু মিলে বিকেলে ফার্মগেট পার্কে (বর্তমানে মেট্রোরেলের ডিপো) বসে আড্ডা দেওয়া ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। একদিন বন্ধু বাবুল হঠাৎ করে বলল, আমরা চাইলে ইনকিলাব পত্রিকার ফটোকম্পোজ বিভাগের ইনচার্জ ইফতেখার ভাইয়ের কাছে কম্পিউটারে বাংলা টাইপ শিখতে পারি। আমি সঙ্গেসঙ্গেই রাজি হলাম। একদিন বাবুলের সঙ্গে তার বাসায় গেলাম। আগ্রহ দেখে খুশি হয়ে আমাদের কম্পিউটার শেখানো শুরু করলেন। বেক্সিমকো কম্পিউটার তখন অ্যাপল ম্যাক কম্পিউটার মার্কেটিং করত। এর সঙ্গে বাংলা শহিদলিপি ফন্টও কিনতে হতো। কম্পিউটারের কমান্ডগুলো লেখা থাকত বাংলায়। যেমন : রিস্টার্ট-শুরু করুন, শাট ডাউন-বন্ধ ইত্যাদি। মেনুবারের লেখাগুলোও বাংলায় থাকত।

নিজের কম্পিউটার ছিল না। আমরা কর্কশিট দিয়ে কীবোর্ড তৈরি করে বাংলা টাইপ অনুশীলন করতাম। ফার্মগেটের কাছে একটি প্রতিষ্ঠানে মুনীর অপটিমা টাইপ মেশিনে ইংরেজি টাইপের প্রশিক্ষণও নিলাম। এরই মধ্যে খবর পেলাম দৈনিক আজাদ পত্রিকা কম্পিউটার এনেছে। ইফতেখার ভাই যোগাযোগ করে বললেন, চাইলে আমরা দু’জন সেখানে প্রশিক্ষণ নিতে পারি। সুযোগ হাতছাড়া না করে প্রতিদিন সন্ধ্যায় প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করলাম।

দৈনিক পত্রিকাগুলো তখন ব্যাপকভাবে কম্পিউটারের ব্যবহার শুরু করল। কারণ ফটোকম্পোজে খরচ বেশি। এ ছাড়া লেটারপ্রেসগুলোও কম্পিউটারের দিকে ঝুঁকতে আরম্ভ করল। তখন দ্রুত শেখার জন্য উঠেপড়ে লাগলাম। পত্রিকার কলামের পরিমাপ সম্পর্কে ধারণা হলো। ছোটখাট বিজ্ঞাপনের ডিজাইনও করতে শিখলাম। এমন সময় খবর পেলাম ওয়ারিতে নাটোর প্রেসে একজন কম্পিউটার অপারেটর নেবে। যোগাযোগ করে সেখানে চাকরি নিলাম।

ছাত্রজীবনেই চাকরি! বেশ হিরো হিরো ভাব। আগে যেখানে সামান্য চা-পুরি দিয়ে নাশতা করলেই মন ভরে যেত। এখন সেখানে বিখ্যাত হোটেল সুপার স্টারে দুপুরের খাবার খেতে শুরু করলাম। অসাধারণ সব খাবার! ভালোই চলছিল। একদিন বন্ধু বাবুল বলল, ব্র্যাক কম্পিউটার সেন্টার লোক নিচ্ছে। যোগাযোগ করলাম। তখন ব্র্যাক কম্পিউটার সেন্টার (বিসিসি)-এর ইনচার্জ ছিলেন কল্লোল কান্তি দত্ত। গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। আস্তে আস্তে কথা বলেন। তিনি সামান্য আলাপ-আলোচনা শেষ করেই পরীক্ষা দিতে বললেন। এরপর ঠিকানা রেখে পরে জানাবেন বললেন। তখন মোবাইল ফোন ছিল না। সেজন্য খবর পেতে দেরি হতো। অবশ্য কয়েকদিনের মধ্যেই খবর পেয়ে নিয়োগপত্র হাতে পেলাম। পদবি ডিইটি (ডুয়েল এন্ট্রি টেকনিশিয়ান)। পদবি দেখে খুশি হলাম। ৯ই সেপ্টেম্বর ১৯৮৯-এ ব্র্যাকে যোগ দিলাম। ১ বছর শিক্ষনবিশকাল। এরপর আবেদ ভাইয়ের স্বাক্ষরিত চাকরি স্থায়ী হওয়ার চিঠি পেলাম।

প্রদীপ কুমার সাহা

কল্লোল কান্তি দত্ত যাকে আমরা দত্ত দা বলে ডাকতাম, তিনি সহজ-সরল হলেও নিয়মের ক্ষেত্রে কঠিন। কাজের হিসাব রাখতে লগশিটে লেখা হতো কে কী করছে। ৩ শিফটের অফিস। সকাল (সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা), দুপুর (দুপুর ২টা থেকে রাত ১০টা), রাত (রাত ১০টা থেকে ভোর ৬টা)। পর্যায়ক্রমে সবাইকে ৩ শিফটেই কাজ করতে হতো। রাতের শিফটে কাজ করার সময় প্রায়ই ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসত। কিন্তু দত্ত দা থাকলে বন্ধ করার উপায় ছিল না। ব্র্যাক জীবনের প্রথম ৪ বছর কীভাবে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে সময়কে কাজে লাগাতে হয়, তা শিখেছি।

ব্র্যাকের নানা বিভাগের কাজ কম্পিউটার সেন্টার থেকে হতো। তখন কারও কম্পিউটার ছিল না। সবাই কাজ রিকুইজিশনের মাধ্যমে কম্পিউটার সেন্টারে পাঠাত। তুলনামূলকভাবে প্রকাশনা বিভাগের কাজ থাকত বেশি। কাজগুলো ছাপা হতো বলে আলাদা গুরুত্ব ছিল। প্রকাশনা বিভাগের বাংলা কাজ নির্ভুল করতে দায়িত্ব নিতেন সুবলকুমার বণিক। লেখা কম্পোজ করে দেওয়ার পর তিনি সম্পাদনা করতেন। তাঁর লাল কালির কাটাকুটির কথা কে না জানে! দেখলে মনে হতো হিজিবিজি আঁকিবুকি! সেখানে কী যোগ বা কী বিয়োগ তার নিখুঁত নির্দেশনা থাকতে। ওই কাজে আমার বাংলা বানানের জ্ঞান বাড়ল! বানান নিয়ে সুবল দা’র সঙ্গে কথা হতো। তিনি সহজ করে বুঝিয়ে দিতেন। তাতে মনে রাখা সহজ হতো।

সুবলদার হিজিবিজি আঁকিবুকি

‘দুর্ঘটনা’ বানান ‘হ্রস্ব উ-কার’-এর বদলে ‘দীর্ঘ ঊ-কার’ লিখে ভুল করতাম। দাদা বলতেন, ‘শোনেন, দ-এর সঙ্গে ‘দীর্ঘ ঊ-কার’ শুধু পাঁচটি শব্দে ব্যবহৃত হবে। যেমন : দূর, দূত, দূর্বা, দূষণ ও দূতাবাস। এ ছাড়া বাকি সব দ-যুক্ত শব্দে ‘হ্রস উ-কার’ হবে।’ এরপর ভুল করলে চলে?

ব্র্যাক প্রকাশনা থেকে ব্র্যাক স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য গল্পের বই, মাসিক পত্রিকা ‘গণকেন্দ্র’ এবং ব্র্যাককর্মীদের জন্য অভ্যন্তরীণ মুখপত্র ‘সেতু’ নিয়মিত প্রকাশিত হতো। ব্র্যাক স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য বিখ্যাত সব উপন্যাসের সহজ সংস্করণ প্রকাশিত হলো। ফেরদৌসীর শাহনামা, বিষাদসিন্ধু, মেঘনাদবধ কাব্য, কপালকুণ্ডলা, নৌকাডুবি, কুহেলিকা, মলুয়া সুন্দরী, মহুয়া প্রভৃতি। প্রায় ৪০টি সহজ সংস্করণকৃত বই প্রকাশিত হয়েছিল। সুবলদাকে জিজ্ঞেস করলাম, এত সহজ ও সংক্ষিপ্ত কেন? বললেন, ‘আবেদ ভাইয়ের স্বপ্ন। তিনি চান ব্র্যাক স্কুলের শিক্ষার্থীরা সেরা সাহিত্যগুলো পড়ুক। ১৯৯৪ সালে প্রকাশনা বিভাগে কম্পিউটার কেনা হলে সুবল দা আমার নাম প্রস্তাব করলেন। সেই থেকে প্রকাশনা বিভাগের কাজের সঙ্গে যুক্ত।

প্রকাশনা বিভাগে যুক্ত হওয়ার পরে সুবলদা বললেন, আপনি তো ভালোই বাংলা টাইপ করেন। এখন পেজ ডিজাইন বা মেকআপের কাজও শিখতে পারেন। এ কথা শুনে শেখার আগ্রহ বেড়ে গেল। আমি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সমসাময়িক পরিচিতজনের কাজ থেকে পেজমেকার, ইলাস্ট্রেটর ও ফটোশপ শিখতে শুরু করলাম। একপর্যায়ে গল্পের বই, সেতু ও পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত শিশুকিশোরদের পত্রিকা ‘সাতরং’ টাইপের পাশাপাশি পেজ ডিজাইনের কাজও করতে আরম্ভ করলাম।

ব্র্যাক প্রকাশনা থেকে ‘গণকেন্দ্র’ ও ‘সেতু’ পত্রিকা প্রকাশিত হতো। গণকেন্দ্র প্রতিটি ব্র্যাক স্কুলে ৫ কপি করে পাঠানো হতো। শিক্ষার্থীদের জন্য ৪ ও শিক্ষকের জন্য ১ কপি। তখন ৩৫ হাজারের বেশি স্কুল ছিল। ব্র্যাক স্কুল, অন্যান্য এনজিও এবং বিক্রির জন্য প্রতি মাসে প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার পত্রিকা ছাপতে হতো। বাংলাদেশ রেলওয়ে মেইল সার্ভিসের মাধ্যমে এসব পত্রিকা দেশের আনাচে-কানাচে পাঠানো হতো। বিশাল কর্মযজ্ঞ! ‘সেতু’ শুধু ব্র্যাককর্মীদের জন্যই প্রকাশিত হতো। সকল কর্মীই ১ কপি করে পেতেন। মনে পড়ছে সেই সময় পুরো ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে আমরা সকলে মিলে বাংলা একাডেমি আয়োজিত ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’-তে ব্র্যাক প্রকাশনার স্টলে দায়িত্ব পালন করতাম।

একসময় নতুন বই প্রকাশ বন্ধ হলো। তবে ‘সাতরং’ ও ‘সেতু’ পত্রিকা প্রকাশিত হতো। পরবর্তীকালে ‘সাতরং’ পত্রিকার প্রকাশনাও বন্ধ হয়ে গেল। সময়ের সঙ্গেসঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োজনে প্রকাশনা বিভাগ, কমিউনিকেশন ও পাবলিক অ্যাফেয়ার্স একীভূত হয়ে কমিউনিকেশনস হলো এবং আমি ডিজাইন ইউনিটের সঙ্গে যুক্ত হলাম।

জীবনের এই পর্যায়ে এসে পেছনে ফিরে তাকালে অনেকের কথাই মনে হয়। পথ চলতে চলতে মনে হয়, উপভোগের রয়েছে কিছু কি বাকি? আবার মনে হয়, জীবন তো উপভোগ্যই হয়েছে। যা হয়েছে তাকে তুচ্ছ করে দেখা তো কঠিন। কিছু সুখানুভূতি দিয়ে ভরা জীবনপথের আনন্দ ও স্মৃতিটুকুই না হয় সম্বল হয়ে থাক।

5 1 vote
ব্লগটি কেমন লেগেছে?