ব্র্যাক ব্রিজ ইন্টার্নশিপে সুযোগ পাওয়ার পর থেকেই ফিল্ডে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে ছিলাম। ভার্সিটি জীবনে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়, কখনও সমুদ্র, কখনও নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়াতে গিয়ে প্রান্তিক জনজীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়া আমার কাছে খুব স্বাভাবিক একটা বিষয় হয়ে উঠেছিল। আর তাই ময়মনসিংহ যাওয়ার দিন যতই কাছে আসছিল, আমার উত্তেজনাও যেন ততই বাড়ছিল।
কাজের সূত্রে ব্র্যাকের বিভিন্ন কর্মসূচি সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি তা মাঠ পর্যায়ে গিয়ে দেখে আসার সুযোগ! দারুণ ব্যাপার হলো একসঙ্গে যাচ্ছি বেশ কয়েকজন। আমার যদি পৌঁছাতে দেরি হয়ে যায় সেকথা ভেবে খুব টেনশন হচ্ছিল। আগের রাতে তো ঠিকমতো ঘুমই হলো না। মনে হচ্ছিল, এই বুঝি সকাল হয়ে গেল, সবাই আমাকে রেখেই বেরিয়ে পড়বে এবং আমি বুঝি গাড়িই মিস করব! এসব ভাবতে ভাবতে কানের পাশে অ্যালার্ম বেজে উঠল। তড়িঘড়ি করে তৈরি হয়ে মহাখালীতে ব্র্যাকের হেড অফিসে পৌঁছাই। যথারীতি আমিই লেট! শেষ গাড়িটায় উঠে রওনা দিলাম আমরা আটজন। বাকিদের গাড়ি আরও আগেই যাত্রা শুরু করেছে।
গাড়িতে একথা-সেকথার আড্ডা জমে উঠেছিল বেশ। ঘণ্টাখানেক পর শহরের সীমা ছাড়িয়ে গাজীপুরের এক হোটেলে থামলাম। অন্য গাড়িগুলোও সেখানে দাঁড়ায়। আমরা সবাই একসঙ্গে নাশতা খেলাম। তারপর আবার রওনা।
এই তো মাত্র কিছুদিন আগে সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোনো বেশ কয়েকজনের সঙ্গে শুরু হয়েছিল আমার ব্রিজ ইন্টার্নশিপের যাত্রা। ছয় মাসের মধ্যে তিন মাস পেরিয়ে গেছে! উন্নয়ন খাতে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ডিজাইন করা হয়েছে ব্রিজ ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম—সার্কুলারে এমনটা দেখে আমিও অ্যাপ্লাই করেছিলাম। এরপর নানা ধাপ পেরিয়ে আসে ব্র্যাকে কাজ করার সুযোগ।
ইন্টার্ন হিসেবে যোগদানের পরপরই আমাদের জন্য আয়োজন করা হয় অনবোর্ডিং সেশন। ব্র্যাকের কর্মপরিবেশ, কালচার ও নীতিমালা সম্পর্কে প্রাথমিক দিকনির্দেশনা দেয়া হয় এই সেশনে। জানতে পারি ব্র্যাকের মূল্যবোধ, ডিএনএ, ইকোসিস্টেম এবং সেইফগার্ডিং নিয়ে। পাশাপাশি একটি ওয়ার্কশপেও অংশ নিই আমরা। সেখানে পেয়েছি জীবনমুখী ও ক্যারিয়ার সংক্রান্ত নানা বিষয় নিয়ে জানার সুযোগ। দলগতভাবে কাজ করার কৌশল ও নেতৃত্বের গুণাবলি সম্পর্কেও জেনেছি।

অনবোর্ডিং সেশনে
ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়ে ধরে আমাদের গাড়ি চলতে থাকল। সকাল সাড়ে ১০ টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম ত্রিশালে। শুনেছি, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কৈশোর কেটেছে এই অঞ্চলে। সেজন্যই কিনা জানি না এক অন্যরকম টান অনুভব করছিলাম। ত্রিশালে আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল ব্র্যাকের রিজিওনাল অফিস। সেখানে দায়িত্বে থাকা ভাই ও আপারা আমাদের সারাদিনের শিডিউল নিয়ে একটি ব্রিফিং দিলেন। কোথায় যাব, কার সঙ্গে দেখা হবে, কী কী দেখতে পারব সব শুনে একরকম প্রস্তুতি নিতে থাকি মনে মনে। তারপর শুরু হলো যাত্রা। এবারের গন্তব্য দেওয়ানিয়াবাড়ি।

ময়মনসিংহে ব্র্যাকের রিজিওনাল অফিসে সারাদিনের শিডিউল নিয়ে ব্রিফিং
চারটি মাইক্রোবাস এগিয়ে চলেছে গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ ধরে। বাইরের কড়া রোদে গাড়ির ভেতরটা চলন্ত ওভেন বললেও মনে হয় ভুল হবে না! রাস্তা জায়গায় জায়গায় উঁচু-নিচু, ভীষণ ঝাঁকি। জানালা দিয়ে হঠাৎ বাইরে তাকিয়ে দেখি, কী সুন্দর সবুজ চারদিক! বিস্তীর্ণ সবুজ ধানখেত আর মাঝে মাঝে ছোট ছোট পুকুর। দেখতে দেখতে পথ ফুরিয়ে এলো। গাড়ি থামল, সবাই নেমে সরু মেঠো পথে হাঁটতে শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে গাইছিলাম, “গ্রাম ছাড়া ওই রাঙামাটির পথ…আমার মন ভুলায় রে……”

গ্রামের মেঠোপথ ধরে আমরা হাঁটছি
কিছুক্ষণ পর একটি বাড়ির উঠানে গিয়ে উপস্থিত হই আমরা। দেখি চটের ওপর কয়েকজন মধ্যবয়সী নারী বসে আছেন। আমাদের দেখে তারা একটুখানি হাসলেন। আমরাও হাসিমুখে তাদের সঙ্গে বিছানো চটের ওপর বসে পড়লাম। শুরু হলো পরিচয় পর্ব।
ব্র্যাকের ভাইয়েরা তাদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমরাও নিজেদের নাম বললাম। এখানে আসা নারীরা সবাই ব্র্যাক মাইক্রোফাইন্যান্স কর্মসূচির (দাবি-দারিদ্র্য বিমোচন) ক্লায়েন্ট। দেশের প্রচলিত ব্যাংকিং খাতের বাইরে থাকা নানা পেশার মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটানো থেকে শুরু করে তাদেরকে আর্থিক সেবার আওতায় নিয়ে আসার জন্য কাজ করছে এই ‘দাবি’ কার্যক্রম। এর আওতায় সদস্যদের দেওয়া হয় জামানত ছাড়া ঋণ।
প্রতি মাসে একবার গ্রাম সংগঠনের (ভিও) মিটিংয়ে উপস্থিত হন সদস্যরা। সেখানে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। ঋণের টাকা কীভাবে ব্যবহার করলে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া যায়, সঞ্চয়ের গুরুত্ব, বিমার সুফল, বাল্যবিয়ে ও যৌতুকের ক্ষতিকর প্রভাব, এমনকি নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতার কথাও উঠে আসে সেই আলোচনায়।

গ্রাম সংগঠনের (ভিও) মিটিংয়ে
আমরাও সে মিটিংয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলি। মন দিয়ে শুনি দিন বদলের গল্পগুলো। কেউ গরু কিনে ব্যবসা শুরু করে ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়েছেন, কেউবা গ্রামের ভেতর জমি কিনেছেন, কেউ গড়ে তুলেছেন মুরগির খামার, আবার কেউ করেন মাছের চাষ। তাছাড়া প্রায় সবাই তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠিয়েছেন, জমি কিনেছেন, নিজেদের জন্য বাড়ি করেছেন।
একপর্যায়ে গ্রাম সংগঠনের সভানেত্রী জোছনা আপার সঙ্গে কথা হলো। তিনি ৩০ বছর ধরে ব্র্যাকের সঙ্গে আছেন। কথা বলতে গিয়েই আবেগাপ্লুত হয়ে বললেন, “আমার তিনডা ছেলেমেয়েরে ম্যাট্রিক পাশ করাইছি। পাঁচ কাঠা জমিন কিনছি। আর কী চাইমু! সবই তো পাইলাম!”
তার এই কথার ভেতরেই যেন লুকিয়ে ছিল একজন নারীর সংগ্রাম, আত্মবিশ্বাস আর সাফল্যের গল্প।
সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা আবার উঠে পড়লাম গাড়িতে। গেলাম ধানীখোলায় মাইক্রোফাইন্যান্সের প্রগতি থেকে ঋণ নেওয়া দুই ব্যবসায়ীর সঙ্গে দেখা করতে। প্রগতি থেকে ঋণ নিয়ে কী করেন?—এমন প্রশ্নের উত্তরে মোকসেদুর রহমান জানালেন, “এই যে ছেলেটারে বিদেশে পড়তে পাঠাইছি, মেয়েটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, ব্যবসাটাও এখন আগের চাইতে আরও বড় করছি।”
আলাপচারিতা শেষে আমরা যাই বৈলরের একটি গ্রামে। দেখলাম, টেবিলের ওপর কিছু প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সরঞ্জাম, ওষুধ আর চশমা রাখা। পেছনে ব্যানারে লেখা ‘স্বাস্থ্যসেবা ও চক্ষু পরীক্ষা ক্যাম্প’। আমাদের সঙ্গে থাকা ব্র্যাকের ভাই বুঝিয়ে বললেন কীভাবে স্বাস্থ্যকর্মী আপারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেবা পৌঁছে দেন প্রান্তিক মানুষের দোরগোড়ায়।
উঠানের একপাশে বসে ছিলেন একজন বয়স্ক নারী। তাঁর চোখে ছিল নতুন একটি চশমা, যা তিনি এখান থেকেই পেয়েছেন। চশমা পরে তিনি এখন বেশ ভালোই দেখতে পান বলে জানালেন। ছোট একটি সহায়তা যে জীবনকে মুহূর্তেই কতখানি বদলে দিতে পারে, তা তাঁর চোখেই স্পষ্ট ধরা পড়েছে।

‘স্বাস্থ্যসেবা ও চক্ষু পরীক্ষা ক্যাম্প’-এ
হেলথ ক্যাম্পে কিছু সময় কাটিয়ে আমরা রওনা দেই আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশনের উদ্দেশে। যে আড়ং-এর পোশাক সবসময় পছন্দের শীর্ষে থাকে, সেগুলো কোথায়, কীভাবে আর কারা তৈরি করে তা দেখব! বেশ উত্তেজনা কাজ করছিল আমাদের ভেতর। কিন্তু পৌঁছেই হাতমুখ ধুয়ে সোজা যেতে হলো খাবার টেবিলে। কারণ পরিকল্পনামাফিক আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশনে আমাদের দুপুরের খাবারের আয়োজন আগে থেকেই করা ছিল।
খাওয়ার পর সেখানকার এক ভাই আড়ং-এর ইতিহাস, কীভাবে কাজ করে, কারা কাজ করে সব বিষয়ে আমাদের ধারণা দিলেন। তারপর গেলাম ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন ফ্লোর ঘুরে দেখতে। কর্মীরা সবাই অনেক ব্যস্ত। কেউ ব্লক প্রিন্টের কাজ করছেন, কেউ রঙের সাথে রঙ মিলিয়ে নতুন শেড তৈরি করছেন, তো কেউ সুইসুতা দিয়ে কাপড়ে নকশা ফুটিয়ে তুলছেন, কেউ আবার সেলাই মেশিনে বিভিন্ন সাইজের জামা সেলাই করছেন, আর সবশেষে কেউ কেউ ব্যস্ত জামা ইস্ত্রি করায়। কীভাবে টিমওয়ার্কের মাধ্যমে একেকটি জামা তৈরি হয় তা চোখের সামনে দেখলাম।

ব্লক প্রিন্টের সাহায্যে কাপড়ের ওপর ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে বাহারি নকশা
আর্টিসানদের বিভিন্ন কাজ দেখতে দেখতে কখন যে ফেরার সময় হয়ে এলো তা টেরই পাইনি। ফিল্ড ভিজিটের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য আমরা আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশনের সামনে দাঁড়িয়ে গ্রুপ ছবি তুললাম। সবাইকে বিদায় জানিয়ে আমাদের গাড়ি চলতে শুরু করল। এতগুলো মানুষের বুকভরা সাহস আর কাজের প্রতি একাগ্রতা ও ভালোবাসাকে সঙ্গে নিয়ে বাসায় ফিরলাম।
অনেকের গল্প এখন আমার ঝুলিতে। নিঃসন্দেহে একদিনেই আমার অভিজ্ঞতার ঝুলিটা অনেক ভারী হয়ে গেল।

আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশনে আমরা সবাই



