নেতৃত্বগুণের ক্ষমতা অসীম!
সেই ক্ষমতা সুপারভাইজার, লাইন ম্যানেজার কিংবা কোনো পদাধিকার বলে আসে না। সেটা আসে মানুষের মনে জায়গা করে নেওয়ার ক্ষমতা থেকে। কখনও সঠিক দিকনির্দেশনা, কখনও পরামর্শ অথবা সহমর্মিতাপূর্ণ একটি কথা বা আচরণ দিয়ে একজন নেতা পরশপাথর-এর মতোই আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলেন। তাই ব্র্যাকে সুযোগ্য নেতৃত্বের মানে ম্যানেজার বা সুপারভাইজার-এর পদবি ছাপিয়ে ‘আপা’ বা ‘ভাই’ হয়ে ওঠা।
ব্র্যাক জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য নেতৃত্বের গল্প লিখে পাঠানোর প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ব্র্যাককর্মীরা সারাদেশ থেকে ৬শয়ের বেশি গল্প পাঠিয়েছিলেন। দীর্ঘ ৭ মাসের অভিযাত্রায় মোট ৫৩ জন বিচারক ৩টি ধাপে গল্পগুলো থেকে বাছাইয়ের মাধ্যমে ২৪টি গল্পকে চূড়ান্ত পর্বের জন্য মনোনীত করেন। সেখান থেকেই বিজয়ী হয়েছে সেরা ৬টি গল্প।
বিজয়ী গল্পের লেখক ও গল্প সম্পর্কে ছোট করে জেনে নিই-

মোসাম্মৎ জেবুন্নেসা। ৩৪ বছর আগে তার ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন প্রয়াত মোঃ আমিনুল আলম ওরফে আমিন ভাই। চাকরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রশিক্ষণের জন্য তাঁকে যশোর টার্কেযেতে হয়েছিল। নতুন কর্ম, এবং পথঘাট কিছুই চেনা নেই। সেদিন আমিন ভাই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কীভাবে গিয়ে কোথায় নামতে হবে। ব্র্যাক জীবনের শুরুতে এভাবেই তার পরিচয় হয়েছিল একজন পরশপাথর-এর সঙ্গে।
সুদীর্ঘ কর্মজীবনে আমিন ভাইয়ের দূরদর্শিতা, কাজের প্রতি নিষ্ঠা, ন্যায়পরায়ণতা, অসাধারণ স্মৃতিশক্তি এবং কর্মীদের প্রতি তার সহানুভূতিশীল আচরণ বারবার তাকে মুগ্ধ করেছিল। আমিনভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তাঁর পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা প্রতিনিয়তই তাঁকে অনুপ্রাণিত করে। পেশাগত জীবনে একজন অভিভাবক হয়ে তার পাশে ছিলেন আমিন ভাই।

আবেদ ভাই ব্র্যাকের কার্যক্রম দেখতে নাটোর হয়ে রাজশাহী যাবেন। নাটোরের ব্র্যাক অফিসে যাত্রাবিরতির সময়ে সেখানে কর্মরত মো. জিল্লুর রহমান দেওয়ান তাঁকে বলেছিলেন, ‘ঋণ দেওয়ার সময় অংশগ্রহণকারীদের আমরা ১০টি মুরগি ও রিং-স্ল্যাব দিই। কিন্তু তারা শুধু মুরগি নিতে চায়, রিং-স্ল্যাব নয়। তাহলে তাদেরকে কি শুধু মুরগিই দেব?’
আবেদ ভাই পাল্টা জানতে চেয়েছিলেন, তোমার কি মনে হয় তারা মানসম্মত জীবনযাপন করছে? সবার বাসায় ল্যাট্রিন আছে? তারা কি পুষ্টিকর খাবার খাচ্ছে? তাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে? যদিও চুপ ছিলাম, কিন্তু মনে মনে উত্তর দিলাম ‘না’।
আবেদ ভাই বলেছিলেন, ‘অনেকে বুঝতেই পারে না যে, এসব তারা পেতে পারে। দায়িত্ব নিয়ে তাদের সঙ্গে কাজ করলে, আমার বিশ্বাস আগামী ১০ বছরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন এবং দারিদ্র্য মোকাবিলায় আমরা সফল হব।’ আবেদ ভাইয়ের বলা কথাগুলো তাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল। এখনও তিনি নিজে নেতৃত্ব দিয়ে সমাজ ও মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে চলেছেন।

সাইকেল চালিয়ে গ্রামে স্কুল ভিজিটে যাওয়ার সময় ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আয়েশা আক্তারের পিছু নিত আর ছড়া কেটে মজা করত। এসব শুনে মন খারাপ করে একসময় ভেবেছিলেন, চাকরিটাই ছেড়ে দেবেন। কিন্তু ম্যানেজার এনামুল ভাই সবকিছু শোনার পর বলেছিলেন, ‘আপনি এটুকুতেই বিরক্ত হচ্ছেন! তাদের সঙ্গে মেশেন, কথা বলেন। দেখবেন, ওরা ভুল বুঝতে পারবে এবং আপনার কাজে সহায়তা করবে।’
ভাইয়ের কথা মতো কাজে যাওয়ার পথে ওই শিশুদের সঙ্গে দেখা হতেই আয়েশা আক্তার তাদেরকে ডেকে কথা বললেন। তাদের মা-বাবার সঙ্গেও পরিচিত হলেন। গ্রামের মানুষেরা তাকে চিনল এবং তার কাজ সম্পর্কে জানল। তিনি হয়ে উঠলেন পরিচিত ব্র্যাক আপা। সেই ছেলেমেয়েদেরকে তিনি স্কুলে ভর্তি করাতে পেরেছিলেন এবং তার সব বাধাও দূর হয়েছিল।
এনামুল ভাই তাকে এগিয়ে যাওয়ার সাহস জুগিয়েছিলেন। এনামুল ভাইয়ের সেই পরামর্শ তিনি সবসময় মনে রাখেন।

মো. তৌহিদুল হক ২০২২ সালে শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতি উপজেলার ধানশাইল শাখায় ব্র্যাক মাইক্রোফাইন্যান্স প্রোগ্রামে যোগদান করেন। তৌহিদুল ভাইয়ের পরশপাথর একই অফিসের শাখা ব্যবস্থাপক, মো. জাহিদুল ইসলাম। চাকরিতে যোগদানের প্রথমদিন জাহিদুল ভাই বলেছিলেন, ‘এমন কোনো কাজ নেই, যা মানুষ করতে পারে না। এজন্য প্রয়োজন সততা, কঠোর পরিশ্রম এবং প্রবল ইচ্ছেশক্তি।’ কথাগুলো শুধু সেদিন নয়, এখনও তাকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।
১৪ মাস জাহিদুল ভাইয়ের ধারাবাহিক সমর্থন, অনুপ্রেরণা তাকে কর্মক্ষেত্রে সকল বাধা অতিক্রম করতে সহায়তা করেছে। জাহিদুল ভাইয়ের নিবিড় পর্যবেক্ষণ, গঠনমূলক মতামত এবং কাজের স্বাধীনতা প্রদান তার শেখার আগ্রহ ও সুষ্ঠুভাবে কাজ শেষ করার আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছে।
তৌহিদুল ভাই সামনে এগিয়ে যাবেন এবং তার লক্ষ্য পূরণে সফল হবেন।

তাসলিমা খাতুনের বাড়ি সিরাজগঞ্জ আর চাকরি করতে যেতে হলো রংপুর। তিনি ভেবেই নিয়েছিলেন এই চাকরি করা যাবে না। কিন্তু প্রথমদিন তাসলিমা খাতুনের সুপারভাইজার মোহাম্মদ শাহে আলম ভাই এবং টিমের অন্যদের উষ্ণ অভ্যর্থনায় কেটে যায় ভয় আর শঙ্কা। সকলের আন্তরিকতায় নতুন পরিবেশের সঙ্গে এতটাই মানিয়ে নিয়েছিলেন যে, কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও বাঁশের সাঁকো পার হয়ে অথবা প্রত্যন্ত জমির আইল পেরিয়ে কাজে যেতেও দ্বিধা করেননি।
কাজের প্রয়োজনে আলম ভাইকে তাসলিমা আপার অনেক প্রশ্ন করতে হতো। তাঁকে কখনও বিরক্ত হতে দেখেননি, বরং নিজের অভিজ্ঞতার গল্প শোনাতেন। কীভাবে করলে ভালো হবে তা শেখাতেন। এক অর্থে তাসলিমার কাজ তিনি সহজ করে দিয়েছিলেন। শাহে আলম এখন অবসরজীবন কাটাচ্ছেন। তিনি এখনও পরশপাথর-এর মতোই রয়েছেন তাসলিমার সঙ্গে।

ব্র্যাকে যোগদানের পর রাসেল আহমেদ তাঁর পরশপাথর খুঁজে পান, তিনি মেহেদী হাসান ভাই ।
মেহেদী ভাই সহকর্মী হিসেবে সবসময় পাশে ছিলেন। তাঁর অনুপ্রেরণা ও সহানুভূতি তাকে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করেছে। মেহেদী ভাই শুধু সুপারভাইজার হয়ে থাকেন না, কখনও ভাই, কখনও অবিভাবক, কখনওবা সহযোগী হয়ে কাঁধে হাত রেখে পাশে থাকেন।
২০১৯ সালে রাসেল যখন মাকে হারান, তখন পাশে ছিলেন মেহেদী ভাই। ২০২০ সালের আগস্টে হঠাৎই হারিয়ে ফেলেন জীবনসঙ্গীকে! স্ত্রীকে হারানোর শোক সেইসঙ্গে ১০ মাস বয়সী কন্যাকে লালনপালনের দুঃশ্চিন্তা! কীভাবে কী করবেন তা নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন। কঠিন সময়ে মেহেদী হাসান মানসিক ও আর্থিক সহায়তা নিয়ে পাশে ছিলেন। স্ত্রীর জানাজায় রাসেল মেহেদী ভাইয়ের চোখ ভেজা দেখে বুঝলেন তার নিজের কষ্ট ভাইও অনুভব করছেন।
মেহেদী ভাইয়ের পাশে থাকার শক্তিকে রাসেল অনুভব করেছিলেন। কেবল পেশাদার সম্পর্ক নয়, তাঁর সহমর্মিতাবোধ কতটা আদর্শিক তা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তো তাঁর অনুপ্রেরণা, উপদেশ আর সঠিক নির্দেশনা পেয়ে রাসেল আবার কাজে ফেরেন। হতাশা আর জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা রাসেল এখন বলেন, তিনি ভালো আছেন। মেয়েকে নিয়ে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেন।



