‘কার্নিভাল অব চেঞ্জ ২০২৪’-এ সারা বাংলাদেশ থেকে এসেছিল দুশো পঞ্চাশ জন তরুণ। ‘আই অ্যাম আ চেঞ্জমেকার’ লেখা সাদা টি শার্ট পরে তারা মেতে উঠেছিল উৎসবে। সাভার সিডিএম-এ ২৬-২৭শে এপ্রিল দু’দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত তারুণ্যের উৎসবে তারা জানান দিল—ভিন্ন ভিন্ন জেলায় বাস, তাদের কাজ ভিন্ন কিন্তু সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সকলেই অঙ্গীকারবদ্ধ।
আমরা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম উদ্যমী তরুণদের বর্ণিল সাজে সাজানো স্টলগুলো।
‘প্রজেক্ট উজ্জীবন’-এর স্টলে গিয়ে জানতে পারলাম, তারা কাজ করছে জলবায়ু সংকট মোকাবিলা ও পরিবেশ রক্ষায়। স্কুলে ‘জলবায়ু ক্লাব’ গঠন করার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদেরকে প্লাস্টিক পণ্য ও পোশাক রিসাইক্লিং সম্পর্কে জানাচ্ছে তারা। এছাড়াও স্টলে বিক্রি হচ্ছে কাগজের তৈরি কলম যেখানে সংরক্ষিত আছে গাছের বীজ। কলমের কালি শেষ হবার পর মাটিতে ফেলে দিলে তা থেকেই হবে চারাগাছ। পুরনো প্যান্ট দিয়ে তৈরি করেছে ব্যাগ। ছাদ বাগান বা কম জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন গাছের চারা রোপণ করতে চান? আছে তাদের বীজ প্যাকেট, এতে অল্প অল্প করে আছে কয়েক ধরনের সবজির বীজ।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কাজ করা ‘ওয়েস্ট টু রিসোর্স’-এর ৬ তরুণের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তারা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বরিশাল শহরের এক কলোনিতে বেড়াতে গিয়েছিল। সেখানকার বাসাবাড়ির ময়লা সরাসরি নদীতে ফেলা হতো, কারণ রাস্তা সরু থাকায় ময়লার গাড়ি যেতে পারে না। এরপর সেখানেই তারা ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টের নতুন এ ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করে। এখন রান্নাঘরের ময়লা আর কীর্তনখোলা নদীর পানিকে দূষিত করে না, বরং তা থেকে পাওয়া যাচ্ছে জৈবসার।

বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগের স্টল ঘুরে দেখছেন ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ্
‘মুক্ত’ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর স্টল। কেন এই উদ্যোগ? এই প্রশ্নের জবাবে তারা জানাল এর পেছনের ঘটনা, কেন তারা ‘মুক্ত’ নিয়ে এতটাই আবেগপ্রবণ। একদিন বন্ধুর জন্য পোশাক কিনতে মার্কেটে গিয়ে অনেক ঘুরেও তারা মাপমতো কোনো পোশাক খুঁজে পায়নি। বরং সেদিন তাদের শুনতে হয়েছিল নানা বাজে মন্তব্য। এই বুলিং সবার মনে গেঁথে গিয়েছিল। এর প্রতিবাদে তারা নিজেরাই পোশাকের দোকান খোলে। এই দোকানের বিশেষত্ব হলো সেখানে অন্য দোকানের মতো সাধারণ মাপের জামা থাকে, আরও থাকে এর চাইতেও বড় ও ছোট মাপের জামা।
‘উদ্যমিতা’ ময়মনসিংহের বিহারি পল্লির নারীদের নিয়ে কাজ করে। তাদের কাপড়ে ব্লক করা শেখায় এবং তৈরি পণ্য বাজারে বিক্রি করতে সাহায্য করে। এ তো গেল কয়েকটির কথা। দেখলাম এরকম আরও কত উদ্যোগ! কেউ কাজ করছে গ্রাম-বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্যকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে, কেউ নারীদের মাসিক ও প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে, কেউ আবার কাজ করছে জেন্ডার সমতা ও অনলাইন সুরক্ষায় মানুষকে সচেতন করতে। সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে বিচিত্র সব চ্যালেঞ্জের সমাধান নিয়ে এগিয়ে এসেছে তারা।

সেশনের ফাঁকে চেঞ্জমেকাররা মেতেছিল লুডু খেলায়
ব্র্যাকের ‘আমরা নতুন নেটওয়ার্ক’ কাজ করে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ এ শিক্ষার্থীদের নিয়েই। জীবনদক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ, পরামর্শ এবং নানাবিধ কার্যক্রমের মাধ্যমে তাদেরকে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বদানের উপযোগী করে গড়ে তোলাই এর লক্ষ্য।
২০১৮ সালে পরীক্ষামূলকভাবে ঢাকা, খুলনা ও রংপুরে শুরু হয় ের কার্যক্রম। ২০২৩ সালের মধ্যে এটি পৌঁছে গেছে বাংলাদেশের ১২টি জেলায় ১৫শর বেশি তরুণের কাছে। এই তরুণ চেঞ্জমেকারদের মধ্যে অনেকে পেয়েছে গেটস ফাউন্ডেশন, নাসা এবং জাতিসংঘ থেকে নানা পুরস্কার ও সম্মাননা। ‘আমরা নতুন নেটওয়ার্ক’-এর অ্যালামনাইরা এখনও যুক্ত আছে এই প্ল্যাটফর্মে। তারা অনুজদের দিচ্ছে প্রয়োজনীয় মেন্টরশিপ।
‘কার্নিভাল অব চেঞ্জ ২০২৪’-কে বলা যায় তরুণ চেঞ্জমেকারদের মিলনমেলা। এখানে দেওয়া হয় ‘আমরা নতুন ইয়াং চেঞ্জমেকার্স অ্যাওয়ার্ড ২০২৪’। বিজয়ী এবং বিজিত প্রত্যেকে ভবিষ্যতে কমিউনিটির জন্য কাজ করার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করে।

আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে ‘আমরা নতুন ইয়াং চেঞ্জমেকার্স অ্যাওয়ার্ড ২০২৪’ বিজয়ীরা
এই উৎসবে তরুণ এই চেঞ্জমেকারদের দক্ষতা উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা প্রদানের জন্য আরও ছিল থেরাপিউটিক আর্ট, জলবায়ু পরিবর্তন, পাবলিক স্পিকিং, নেগোসিয়েশন, ক্যারিয়ার পাথ নিয়ে নানা অংশগ্রহণমূলক ওয়ার্কশপ।

ওয়ার্কশপগুলোতে ছিল তরুণদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ
উৎসব শেষে সবাই বাড়ি ফিরেছে ঠিকই কিন্তু তরুণ চেঞ্জমেকাররা সঙ্গে নিয়ে গেছে এই ভাবনা যে, তারা একা নয়, আরও অনেকে তাদের মতোই নানা সমস্যা সমাধানে কাজ করছে। ভবিষ্যতে সুযোগ আছে সমমনাদের নিয়ে দল গঠন করে আরও বড় পরিসরে কাজ করার।
আর এভাবেই নিজ এলাকায় শুরু করা উদ্যোগ একদিন ছড়িয়ে যাবে সারা দেশে। পরিবর্তনের স্বপ্ন সত্যি হবে হার না মানা উদ্যমী এ তরুণদের হাত ধরেই।

‘কার্নিভাল অব চেঞ্জ ২০২৪’ ছিল আমরা নতুন নেটওয়ার্ক-এর অগ্রজ ও অনুজ চেঞ্জমেকারদের মিলনমেলা



