জীবনে ভাবিনি ব্র্যাকের হেড অফিসি যায়ে রঙিন ফুলকপি, করলা, লাউ, বিক্রি করব। দশ মিনিটের মধ্যি আমার প্রায় ১০০ কেজি সবজি শেষ হয়ে গেছে। ইনাগের দেহে চাষের আগ্রহ আরও বাড়ে যায়।
— আব্দুল ওয়াদুদ বিশ্বাস
এ বছর ২৭শে ফেব্রুয়ারি ছিল আব্দুল ওয়াদুদ বিশ্বাসের জীবনে একটি বিশেষ দিন। তিনি যশোর থেকে সবজি বিক্রি করতে এসেছিলেন ঢাকার ব্র্যাক সেন্টারে। ব্র্যাককর্মীদের জন্য সরাসরি প্রান্তিক সবজিচাষিদের কাছ থেকে পণ্য কেনার আয়োজন করা হয়েছিল।
পুরো ঘটনাটি বলার আগে এটি বলে রাখা ভালো যে, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের জলবায়ু বিপদাপন্নতা সূচকের তালিকায় যশোরের কেশবপুর উপজেলাটির নাম রয়েছে। আর ওয়াদুদ ভাইয়ের বাড়ি সেখানেই।
যেসময়ের কথা বলছি তখন তিনি ছিলেন পেশায় একজন ভ্যানচালক। চাকরিসূত্রে জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির প্রোগ্রাম অর্গানাইজার (পিও) তারিন আপাকে সেখানের বিভিন্ন খেত পরিদর্শনে যেতে হতো। এলাকার সব জায়গা বেশ ভালোমতো চিনতেন ওয়াদুদ ভাই। তাই তার ভ্যানে চড়েই অধিকাংশ সময় যাতায়াত করতেন তিনি।
তারিন আপা জমিতে গিয়ে কৃষক ভাই-আপাদের জলবায়ু-সহনশীল বিভিন্ন কৃষি পদ্ধতি নিয়ে পরামর্শ দিতেন। প্রায় সময়ই খেয়াল করতেন, ওয়াদুদ ভাই পাশে দাঁড়িয়ে শুনছেন। আবার ভ্যান চালানোর সময় তিনি চাষাবাদ নিয়ে অনেক প্রশ্নও করতেন। আগ্রহবশতই একদিন তারিন আপা বলেছিলেন, ‘চাষবাদ করেন নাকি, ওয়াদুদ ভাই? জমি থাকলে বলেন, গিয়ে দেখে আসব।’
ওয়াদুদ ভাই বললেন, ‘নিজির তো কিছুই নেই। একজনের জমি দেহাশুনা করি। সেনে ঘাস ছাড়া আর কিছুই হয় না।’
তারিন আপা তার কথা রেখেছিলেন। সেদিনই তাকে সঙ্গে নিয়ে জমিটা দেখতে গিয়েছিলেন। এরপর সেই জমির মাটি পরীক্ষা করে বললেন, ‘এখানে চাষ করা যাবে। তবে একটু ভিন্ন পদ্ধতিতে করতে হবে।’
পটুয়াখালী, বরগুনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, যশোর, নওগাঁ এবং জামালপুর জেলার অনেক জমিতে আগে চাষ হতো, কিন্তু এখন ভালো ফলন হয় না। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এমনটা হয়। দেখা গেছে সেসব এলাকায় বিঘার পর বিঘা জমি পতিত পড়ে থাকে। ব্র্যাকের এডাপটেশন ক্লিনিক সেইসব জমিতে ভিন্ন পদ্ধতিতে চাষের বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকে।
২০২২ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২২টি এডাপটেশন ক্লিনিক ও ১৫২০টি মোবাইল এডাপটেশন ক্লিনিক থেকে ৪৪ হাজার ৪৪৮ জন কৃষক পরামর্শসেবা, বীজ, আবহাওয়া বার্তা ও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ব্র্যাকের এডাপটেশন ক্লিনিকের তত্ত্বাবধানে ৫৩ হাজার ৮৯৩ বিঘা জমিতে ফসলের চাষ হয়েছে।
ওয়াদুদ ভাই ব্র্যাকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে এডাপটেশন ক্লিনিক থেকে মাটি পরীক্ষা করার পর করলা চাষ করতে বলা হলো। এর জন্য চাষাবাদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় বীজ ও সার দেওয়া হলো। ওয়াদুদ ভাই বলেন, ‘তারিন আফা আমারে মালচিং পেপার বিছেনে ও ভালো করে বীজ লাগানে দেহাই দিতেন। আমি ঠিকঠাক মতো চাষবাস করতেছি কিনা তা মাঝে মধ্যি দেহে যাতো। যহনই কোনো কিছু লাগত, তহনই কৃষি অপিসার এর সাতে কতা কয়াই দেতো।’
তারিন আপা তাকে হাতেকলমে শিখিয়েছেন কীভাবে লতাপাতা, খড় কিংবা পলিথিন দিয়ে গাছের গোড়া, সবজি খেত ও বাগানের বেডের জমি বিশেষ পদ্ধতিতে ঢেকে দিতে হয়। একে বলে মালচ। আর এই পদ্ধতিতে চাষ করাকে বলে মালচিং। এতে খেতে সেচ লাগে কম। তাই খরচ কম, লাভ হয় বেশি। মালচিং পদ্ধতিতে চাষ করলে সূর্যের তাপ ও বাতাসে খেতের পানি দ্রুত শুকিয়ে যায় না,ফলে জমির আদ্রতা ঠিক থাকে এবং আগাছা কম জন্মায়।

হাতেকলমে প্রশিক্ষণ ওয়াদুদ ভাইয়ের দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে
ওয়াদুদ ভাই ১০ শতক জমিতে টেকসই মাচা ও মালচিং পদ্ধতিতে করলা চাষ করেছিলেন। প্রথম মৌসুমে ৯০০ কেজি করলা উৎপাদন হয়, যা ৫৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছিলেন।
প্রথম ফসল বিক্রির অনুভূতি কেমন? এই প্রশ্নের জবাবে হেসে জানালেন, ‘আমি জীবনে এত টাকা একসাথে পাইনি আপা। বুঝোতি গিলি কতি হয়, আপনার পথম বেতন পাওয়ায় যেরাম খুশি হয়লেন আমারও সেইরাম লাগদিলো!’
করলা বিক্রি করে যথেষ্ট টাকা পেয়েছিলেন বলে সেবছর ওয়াদুদ ভাইকে আর ধারদেনা করে সংসার চালাতে হয়নি। পরের রবি মৌসুমে তিনি আরও জমি বর্গা নিয়ে চিচিঙ্গা, রঙিন ফুলকপি ও ব্রকলি চাষ শুরু করেন। একইসঙ্গে সাথি ফসল হিসেবে শালগম, বিট কপি, রসুন, পেঁয়াজ, মরিচ, লাল শাক, পালং শাক ও বাঁধাকপি চাষ করেছেন।
শীতের মৌসুমে ব্র্যাকের এডাপটেশন ক্লিনিক ওয়াদুদ ভাইকে মালাচিং পদ্ধতিতে ব্রকলি ও রঙিন ফুলকপি চাষ শিখিয়েছিল। এভাবে যেকোনো মৌসুমেই যে কত শাকসবজি যে চাষ করা যায়!
ওয়াদুদ ভাইয়ের এই সফল সবজিচাষের খবর এখন গ্রামের অনেকেই জানে। তারা তো চোখের সামনেই দেখেছে বছরের পর বছর পড়ে থাকা জমিটা আজ সবুজে ভরপুর। এভাবেই ব্র্যাক জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির ‘এডাপটেশন ক্লিনিক’ জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষকদের সঙ্গে সরাসরি কাজ করছে। কোনো জমি যেন কোনো ঋতুতেই অনাবাদি না থাকে, সেজন্য এই ক্লিনিকগুলো সবরকম কৃষি সহায়তা দিয়ে থাকে।
ওয়াদুদ ভাই জলবায়ু পরিবর্তনের খুঁটিনাটি বিষয় হয়তো বোঝেন না কিন্তু তিনি মাটির ভাষা বোঝেন। তিনি বিশ্বাস রেখেছিলেন তারিন আপার নতুন পদ্ধতির চাষাবাদের কথায়। তার সাথে আমার শেষ কথা মনে হয় সবার মনে আশার জাগাবে। কারণ তিনি শেষমেষ বললেন,‘আমি খায়ে পরে ভালো রইছি।’

ব্র্যাক সেন্টারে আব্দুল ওয়াদুদ বিশ্বাস



