থ্যাংক ইউ টিচার

তারিখ: 27 অক্টো. 2024

লেখক: সাদিয়া আক্তার

[গত ৫ই অক্টোবর বিশ্বব্যাপী উদযাপন করা হয় বিশ্ব শিক্ষক দিবস। এ উপলক্ষে আমরা কথা বলেছিলাম কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল সরকারি কলেজের প্রভাষক সাদিয়া আক্তার এবং চুয়াডাঙ্গায় সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রিপন হোসেনের সঙ্গে। তারা একসময় ব্র্যাক স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন। আমরা জানতে চেয়েছিলাম, আজকের ‘আপনি’ হয়ে ওঠার পেছনে তাদের শিক্ষক কীভাবে অবদান রেখেছেন? আলাপচারিতায় উঠে এসেছে তাদের প্রিয় শিক্ষকদের নানা গল্প।]

আপা বলেছিলেন, ‘এই মেয়ে খুব সৌভাগ্যবতী হবে, সাদিয়া নামের অর্থ সৌভাগ্যবতী।’

আমার পড়ালেখার হাতেখড়ি ব্র্যাক স্কুলে। সেখানে আমার টিচার ছিলেন রওশন আরা বেগম। আমরা কাছাকাছি বাড়িতে থাকতাম। তাই প্রথমদিন আদর করে তিনিই স্কুলে নিয়ে যান। যতটুকু মনে পড়ে সেদিন গোলাপি রঙের কাপড়ে সাদা বল প্রিন্টের একটা জামা পরেছিলাম। যেহেতু আপার হাত ধরে ক্লাসে ঢুকেছিলাম তাই নিজেকে খুব ‘স্পেশাল’ মনে হয়েছিল।

আমার আজকের জীবনের শুরুর ধাপগুলো গড়ে দিয়েছেন রওশান আরা আপা। সাদিয়া আক্তার—এই নামটাও আপার দেওয়া। সাদিয়া নামের অর্থ সৌভাগ্যবতী। আপা বলেছিলেন, এই মেয়ে খুব সৌভাগ্যবতী হবে।

বাঁশের কাঠির সাহায্যে গণনা শিখছে শিক্ষার্থীরা

রওশন আপা বাঁশের কাঠি দিয়ে গুনতে শিখিয়েছেন। ২০-৩০টা কাঠি বানিয়েও দিয়েছিলেন। সেগুলো একটা টিনের কৌটায় ভরে আমরা স্কুলে নিয়ে যেতাম। যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগ আরও কত কী শিখতাম! অংকের মতো জটিল বিষয় তখন আর কঠিন মনে হয়নি। এ যেন খেলতে খেলতে শেখা। টিনের কৌটায় কাঠির ঝনঝন শব্দ এখনও কানে বাজে। আজ আমি নিজেই শিক্ষক। রওশন আপা এবং ব্র্যাক স্কুলে পড়ালেখা ও নিয়মকানুনের কথা প্রায়ই আমার ছাত্রছাত্রীদের বলি।

পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা শেখে মূল্যবোধ ও নিয়মানুবর্তিতা

ব্র্যাক স্কুলে পড়া শেষে মাধ্যমিক স্কুলে কোথায় ভর্তি হব তা নিয়ে আমার মা-বাবা তেমন গুরুত্ব দিচ্ছিলেন না। রওশন আরা আপা নিজে গিয়ে আমাকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন। এর আগে  সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নাম লিখিয়ে আমি যেন বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি তার ব্যাপারেও উৎসাহ জুগিয়েছিলেন। আপা সবসময় বলতেন, “তুমি পারবে।”

আমার কয়েকজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী এখনও আমার কাছে আসে। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। তারা বলে, “আপনার জন্যই আমরা এখানে এসেছি। আপনার ছোটবেলার স্কুলজীবনের  গল্পগুলো আমাদেরও এতদূর আসতে সাহস জুগিয়েছে।”

আমি যতবারই গ্রামের বাড়িতে যাই, আপার সঙ্গে দেখা করে আসি। এমনকি আপার নিয়মেই আমার ছেলেমেয়েকে পড়তে শেখাই। থ্যাংক ইউ আপা, ছোটবেলার স্বপ্ন ছিল এবং এখনও আমি আপনার মতোই হতে চাই।

আমার আপা যিনি ছিলেন, হামিদা বানুউনি গল্পের মতো করে আমাদের শেখাতেন

আমাদের সময় আশেপাশে যেসব ব্র্যাক স্কুল ছিল তার কোনোটা প্রি-প্রাইমারি ছিল, কোনোটা ক্লাস থ্রি পর্যন্ত, আবার কোনোটা ছিল ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত। আমি ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছি ।

ভাসা-ভাসা মনে আছে একটি সেকশনে তখন ৩৩ জন ভর্তি হতো। ব্র্যাক স্কুল অন্যসব স্কুলের  মতো ছিল না। স্কুলে পড়ার বইয়ের সঙ্গে আমাদের অনেক ভালো ভালো গল্পের বই দেওয়া হতো। আমরা সবাই মিলে কী যে কী খুশি মনে তা পড়তাম! এই যে স্কুলে পড়ার কত নিয়ম তা একে একে শিখিয়েছেন হামিদা আপা, যিনি লালবানু আপা নামেও পরিচিত ছিলেন।

আপা খুব গল্পের মতো করে আমাদের শেখাতেন। যেমন: জাতীয় সঙ্গীত শেষে আমাদের সুর করে বলতে হতো—

তোমরা কি সব…বলতে পারো…একটি করে…ফুলের নাম?…যেমন ধরো…গোলাপ……তোমরা কি সব…বলতে পারো…একটি করে…ফলের নাম?…যেমন ধরো…কাঁঠাল……তোমরা কি সব… বলতে পারো……

কে কত বেশি ফুল-ফলের নাম বলতে পারি তা নিয়ে প্রতিযোগিতা চলত। এভাবে শেখার পুরো প্রক্রিয়াটিই মজার ছিল।

নাচ, গান ও খেলার ছলে চলে আনন্দময় শিখন

আমার হাতের লেখা সুন্দর। হামিদা আপার হাত ধরেই তা শেখা। আমাদেরকে ঈশপের গল্পের মতো মজার মজার শিক্ষামূলক বই পড়তে দেওয়া হতো। সেগুলো থেকে আবার তিনি পরীক্ষাও নিতেন। আমরা গ্রুপ করে গল্পের বই পড়তাম, গ্রুপে লিডার থাকত। এভাবেই ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে লিডারশিপ, টিম বিল্ডিং-এর ধারণা তৈরি হয়।

স্কুল থেকে আমাদের পেন্সিল দেওয়া হতো। তবে নতুন একটি পেন্সিল পাওয়ার আগে ব্যবহার করা পেন্সিলের শেষাংশ জমা দিতে হতো। এসব নিয়ম মানার সময় আপাকে মনে হতো অনেক কঠিন মানুষ। কিন্তু বড় হবার পর বুঝেছি অপব্যয় যেন না করি তা শেখানোর জন্যই এই কঠোর মনোভাব।

নিজের কাজ নিজে করার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য ক্লাসরুম আমাদেরই পরিষ্কার করতে হতো। এরকম ছোট ছোট অনেক অভ্যাস তার কাছ থেকে শিখেছি। আসলে স্কুলের নিয়ম তিনি নিজেও মেনে চলতেন এবং আমরাও যেন মেনে চলি তার খেয়াল রাখতেন। এসব সুঅভ্যাসের চর্চার ফলে আমাদের মন-মানসিকতায় পরিবর্তন এসেছিল। হয়তো তখন বুঝতাম না কিন্তু এখন বুঝি। এটাও ভাবি যে, লালবানু আপার শেখানো বিভিন্ন বিষয় কীভাবে আমার কর্মজীবনে প্রতিনিয়ত সহায়তা করছে।

 

 

আমাদের এলাকায় একটা কথা প্রচলিত আছে যে, বাঁশকে নোয়াতে গেলে, কাঁচা অবস্থাতেই নোয়াতে হয়। আমরা তখন কাঁচা কঞ্চির মতো ছিলাম। আমাদেরকে শিক্ষরাই গড়ে তুলেছেন। তাদের প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। সবদিক থেকে যেভাবে সহায়তা করেছেন, সেটা না করলে হয়তো এই অবস্থানে আমি আসতে পারতাম না। তাদের স্নেহ, ভালোবাসা এবং দোয়া সবকিছুই আজ আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।

আলোকিত সমাজ গড়ার জন্য সকল শিক্ষকের প্রতি জানাই আমাদের শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা।

 

অনুলিখন: এছেন ইলা

5 1 vote
ব্লগটি কেমন লেগেছে?