[বাংলাদেশে বর্তমানে খুবই স্বল্পসংখ্যক এলাকায় ঐতিহ্যবাহী তাঁতের লুঙ্গি বুনন হয়। পাবনা জেলার আটঘরিয়া উপজেলার একদন্ত ইউনিয়নের চাচকিয়া গ্রাম এবং এর আশপাশের কয়েকটি গ্রাম এ শিল্পের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। এই অঞ্চলের তাঁতশিল্পীরা দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে একটি বিশেষ ধরনের লুঙ্গি তৈরি করে আসছেন, যা ‘চাচকিয়ার খটখটি তাঁতের লুঙ্গি’ বা ‘মেঠো তাঁতের লুঙ্গি’ হিসেবে পরিচিত। কালের পরিক্রমায় লুঙ্গিটি কেবল ঐতিহ্যবাহী পোশাক হিসেবেই নয়, বরং সূক্ষ্ম কারুকাজ এবং উচ্চমানের চিকন সুতার জন্য এটি আলাদা করে সবার কাছে সমাদৃত।]
নাজিরা খাতুনের বাড়ি থেকে খটখট খটখট শব্দ ভেসে আসছে। তিনি তাঁত চালাচ্ছেন, এ তারই শব্দ। চারটি লুঙ্গির কাপড় বুনতে তার দেড় দিন সময় লেগে যায়। দিন-রাত মিলিয়ে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। লুঙ্গি বানানোর জন্য প্রায় সমস্ত সুতোই আসে স্পিনিং মিল থেকে। সুতো কেনার পরও বেশ কয়েক ধাপে কাপড় বয়ন করতে হয়।
নাজিরা আপার জন্ম পাবনা জেলার আটঘরিয়া উপজেলার একদন্ত ইউনিয়নের চাচকিয়া গ্রামে। তাঁতে কাপড় বোনা তাদের পারিবারিক পেশা। ছোটবেলায় বাবা-ভাইকে সাহায্য করতেন। সেখান থেকে কাজ শেখা। তাই যখন নিজের বাড়িতে তাঁত দিলেন তখন শক্ত হাতেই হাল ধরতে পেরেছিলেন।

লুঙ্গি বুননের জন্য সুতো আলগা করছেন নাজিরা আপা
সাধারণত মেয়েরা সাহায্যকারী হিসেবেই থাকে, সরাসরি কাপড় বয়নের পেশায় আসে না। বাড়িতে কাপড় বোনা থেকে শুরু করে বাজারে বিক্রি করা পর্যন্ত বেশ কযেকটা ধাপে কাজ করতে হয়। তবে নাজিরা আপার তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার গল্পটা অন্যরকম। বলতে গেলে অন্য কোনো ভালো উপায় না পেয়েই তিনি এ কাজে এসেছিলেন। এখন লুঙ্গি বানানো এবং বাজারে বিক্রির যে প্রক্রিয়া তার প্রতিটিতেই কাজ করছেন। সব কাজ একা করা সম্ভব নয়। অন্যদেরকেও কাজে নিতে হচ্ছে।
গ্রামের অনেক দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের ভাগ্যে সাধারণত যা ঘটে থাকে, নাজিরা আপার সঙ্গেও সেটাই ঘটেছিল। অভাবের কারণে প্রথমে স্কুলে যাওয়া হয়নি। তারপর তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। বাল্যবিয়ে এবং বিয়ের পরপরই গর্ভবতী হয়ে পড়া তার জীবনকে আরও পিছিয়ে দিয়েছিল। তবে সবচেয়ে অন্ধকারময় অধ্যায়টি শুরু হয় গর্ভধারণের মাত্র দেড় মাসের মাথায়। হঠাৎ তার স্বামী নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। নিজের এবং সন্তানের জন্য কীভাবে কী করবে বুঝতে না পেরে নাজিরা খাতুন বাবার হাত ধরে শেখা কাজকেই পেশা হিসেবে বেছে নিলেন।
পড়ালেখা বলতে নাজিরা আপা নিজের নাম লিখতে পারা ছাড়া আর কিছু জানেন না। তেমন কোনো সম্পদও ছিল না। তবে অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও সাহস তাকে থামতে দেয়নি।
নাজিরা আপা বলেন, “মহাজনের কাছ থেইহ্যা সুতা না লিলি মহাজন তো আমার লুঙ্গি লিবি ন্যা। আর আমি যদি একাই লুঙ্গি বানাই, তহন সেই লুঙ্গি একা একা বাজারে লিয়্যা বেচা আমার লাইগ্যা ইট্টু ঝামেলারই অয়া যায়।”
তার এ কথাতেই বোঝা যায় মহাজনদের হাতে কতটা জিম্মি তাঁতশিল্প। দক্ষতা ও পরিশ্রম সত্ত্বেও তারা তাদের ন্যায্য পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তারপরও বলতে হয় সব ধরনের শোষণ-বঞ্চনা পার হয়ে যাওয়ার সমাধানও খুঁজে নিতে হবে আমাদেরকেই।

মায়ের পাশে বসে চরকায় সুতো কাটা দেখছে নাজিরা আপার মেয়ে সুমাইয়া
নাজিরা আপা সাহসী ও উদ্যমী উদ্যোক্তা। তিনি যেভাবে ধীরে ধীরে নিজের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছেন তা অন্যদেরও শক্তি জোগায়। জমি ক্রয়, বসতবাড়ি নির্মাণ, পরিবারের বিভিন্ন প্রয়োজন মেটানো ও ছোট ছোট স্বপ্নপূরণ, মেয়ের পড়ালেখার খরচ চালানো, ছাগল ও হাঁস-মুরগি পালনসহ বিভিন্ন আয়বর্ধক কাজে বিনিয়োগ-এসব কর্মকাণ্ড তার পরিবারের আর্থিক অবস্থার উন্নতিকেই তুলে ধরে। ব্র্যাক মাইক্রোফাইন্যান্স তার প্রত্যেকটি সংকটময় মুহূর্তে পাশে দাঁড়িয়ে তাকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করেছে।
নাজিরা আপার মেয়ে সুমাইয়া নবম শ্রেণিতে পড়ে। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম বড় হয়ে সে কী হতে চায়? সুমাইয়া হাসিমুখে বলেছিল, “বড় হয়ে ডাক্তার হতে চাই।”
সুমাইয়ার স্বপ্ন ও তাঁতশিল্পের ভবিষ্যৎ যেন এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা। একদিকে, সুমাইয়ার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন তার পরিবারের পরিবর্তনের প্রতীক, অন্যদিকে নাজিরা খাতুনের সংগ্রাম তাদের ঐতিহ্যবাহী পেশাকে ধরে রাখার প্রচেষ্টা।

উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণের জন্য প্রস্তুত করছেন কর্মীরা
এই শিল্পের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজন যথাযথ পদক্ষেপ। সুমাইয়ার মতো নতুন প্রজন্মের জন্য এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প আরও সমৃদ্ধ হোক, এটাই সবার কাম্য।
নাজিরা আপা তার মেয়ে সুমাইয়াকে নিয়ে ভালো আছেন। এই ভালো থাকা শুধু তার ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, বরং তা বাংলাদেশের অসংখ্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নারীদের জন্য একটি অনুপ্রেরণার গল্প।



