কালো বাতাসের কান্না

তারিখ: 4 ডিসে. 2019

লেখক: মোঃ ইমদাদুল খান সোহেল

দশ বছরের ছোট্ট শিশুটি মায়ের হাত ছেড়ে দৌড়ে মাঠের দিকে রওনা হলো। মনে হচ্ছে যেন সিনেমার দৃশ্য। কিছুক্ষণ পর শিশুটি মায়ের চোখের সামনে ঝাপসা হতে শুরু করল। দূষণের কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে আশেপাশের সবকিছু। যে সন্তানটি মায়ের আঙুল ধরে হেঁটে চলছিল সে-ই সামান্য দূরত্বে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। দূষণের কুয়াশার এ কাল্পনিক চিত্রই যেন আজ বাস্তব হয়ে উঠছে।

মানুষের চোখ যখন ক্যামেরা হয়ে ওঠে তখন সেই ক্যামারায় বন্দি হয় পুরো শহর, তার ছোটো সব অলিগলি, শহরের সুখ-দুঃখ। এই কদিন আগে আমরা টিভি ক্যামেরায় দেখেছি দিল্লির পথঘাট। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের দিল্লি সফরের সময় সে শহর আমাদের চোখে অশান্তির পরশ বুলিয়ে দেখিয়েছে। সেদিন হয়তো দূষিত বায়ুর মেঘমালা বলছিল, অপেক্ষা করো আমি আসছি ফিরে তোমাদের শহরে। ধুলোর রাজ্যে দিল্লি শহরে আমরা দেখেছি আমাদের ক্রিকেটাররা মুখে মাস্ক পড়ে অনুশীলনে ব্যস্ত। তখন দিল্লি ছিল বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরের তালিকার শীর্ষে।

ঢাকা শহর যেন দিল্লির সঙ্গে সঙ্গেই আছে। কে কখন অন্যকে হারিয়ে তালিকায় এক নম্বরে জায়গা করে নেবে তারই এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে যেন। একটু পেছন থাকলেও হঠাৎ করে টপকে এসে দিল্লিকে পেছনে ফেলে ঢাকা হয়ে গেল বিশ্বের এক নম্বর দূষণের শহর। বড়োই লজ্জার রেকর্ড। কোনো মানুষ চাইবে না তার বসবাসের প্রিয় শহরটি পরিণত হোক দূষণের অন্ধকারে। আজ ঢাকার বাতাসে মৃত্যুর হাতছানি। নাম জানা-অজানা কত রোগ আমাদের ফুসফুসে অনায়াসে জেঁকে বসেছে। শুধু তাই নয় এর প্রভাব পড়ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রিয়জনদের ওপর।

ঢাকার বাতাসে দূষণের হার বেশি। প্রায়ই এর কারণে ঢাকা অস্বাস্থ্যকর শহরের তালিকায় উঠে আসে – এ কথাগুলো আজ নতুন করে শুনলেও তা কিন্তু মোটেও নতুন কিছু নয়। বরং দীর্ঘদিনের অনিয়মের ফসল এই বায়ুদূষণ। আমাদের শীতল ছায়া দিতে রাস্তার মাঝ বরাবর সড়ক দ্বীপের বুক চিড়ে যে গাছ উঠে গেছে, সেই গাছের সবুজপাতা আজ ধুলোয় মোড়ানো বিষণ্ণ মলিন হয়ে পড়ছে। এই ব্যস্ত রাজধানীর সড়কে ছুটে চলা ফিটনেসবিহীন পুরোনো গাড়িগুলোর চলাচল আমরা এখনও বন্ধ করতে পারিনি। গাড়িগুলোর কালো ধোঁয়া ঢেকে ফেলছে শহর। অনিয়ন্ত্রিত কলকারখানাগুলোও পাল্লা দিয়ে ধোঁয়া ছড়াচ্ছে প্রিয় এই শহরে। ঢাকা শহরের পাশেই দাউদাউ করে জ্বলছে কাঠ, পুড়ছে ইট, নতুন কোনো দালানকোঠা গড়ে ওঠার স্বপ্নে।

ইটভাটার চিমনি থেকে বেড়িয়ে আসা ধোঁয়া আজ আমাদের সুস্থ সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্নের মৃত্যু ঘটাচ্ছে। পৃথিবীতে উন্নত দেশগুলোতে এখন আগুনে পুড়ানো ইটের ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। তাই আমাদেরও এই ব্যবস্থা থেকে সরে এসে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। সময়ের প্রয়োজনে ঢাকা শহর থেকে যেমন বেবিট্যাক্সির মতো টুস্ট্রোক ইঞ্জিনের গাড়ি বাতিল করা হয়েছে তেমনি ফিটনেসবিহীন সমস্ত গাড়ি যদি আমরা এই শহর থেকে সরিয়ে ফেলতে পারি তবে গাড়ির কালো ধোঁয়া থেকে শহরবাসী রক্ষা পাবে। এ তো শুধু ঢাকা শহরের কথা বলছি, গ্রামাঞ্চলে দূষণের পরিমাণ হয়তো কিছুটা কম কিন্তু খুব আকাশ-পাতাল তফাৎ আছে বলে মনে হয় না।

শীতের আগমনীর সঙ্গে সঙ্গে এ শহর পরিণত হয় রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির উৎসবে। এক্ষেত্রে সময়ের বণ্টনটাও ভীষণ জরুরি। বিভিন্ন সংস্থাগুলো রাস্তা কেটে যে সেবামূলক কার্যক্রম চালাতে থাকে তার একটি সমন্বয় প্রয়োজন। সেইসঙ্গে প্রয়োজন এ সময়ে নিয়মিত শহরের রাস্তাগুলোতে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করা। সেক্ষেত্রে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের বিশেষ ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে।

ঢাকা শহর কোটি মানুষের শহর। জীবিকার প্রয়োজনসহ নানা কারণে প্রতিনিয়ত মানুষ এ শহরে প্রবেশ করছে। এই ব্যস্ত রাজধানীকে বায়ুদূষণের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সরকারি কার্যক্রমের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলোরও এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে দূষণ থেকে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যায় সে বিষয়ে জনগণকে জানাতে হবে। মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ইপিএর হিসাবে কোনো একটি শহরের বায়ুর মানের সূচক ২০০-এর বেশি হলে তাকে খুবই অস্বাস্থ্যকর বলা হয়। কোনো শহরের বায়ুর মানের সূচক ২০০ ছাড়ালে ওই শহরের মানুষকে মাস্ক (মুখোশ) পরার পরামর্শ দেওয়া হয়। ঘরের জানালা বন্ধ রাখতে হয়, সাইকেলে চড়া নিষেধ করা হয়। সেইসঙ্গে শিশু ও বৃদ্ধদের খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হতে নিরুৎসাহিত করা হয়।

আশার কথা হচ্ছে, মহামান্য আদালত এই বায়ুদূষণ ঠেকানোর একটি নীতিমালা প্রস্তুত করেছে। আমরা চাই এর সঠিক বাস্তবায়ন হোক।

0 0 votes
ব্লগটি কেমন লেগেছে?