কর্মক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব পরিবেশ

তারিখ: 3 ডিসে. 2024

লেখক: শরমিন আকবরী

প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জীবনের বৈচিত্র্যময় অংশ হচ্ছে তার প্রতিবন্ধিতা। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আমরা প্রতিবন্ধিতার এই বৈচিত্র্যকে কতটা গ্রহণ করতে পেরেছি এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য কতটা সহায়ক হয়ে উঠতে পেরেছি। আমরা কি পেরেছি তাদের জন্য একটি  সংবেদনশীল সমাজ গড়ে তুলতে?

প্রতিবন্ধিতা একটি পরিবর্তনশীল ধারণা। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে নানা ধরনের ভ্রান্ত ধারণা আগেও প্রচলিত ছিল, এখনও আছে। কিন্তু ধীরে ধীরে এসকল ভিত্তিহীন ধারণাগুলো পরিবর্তন হচ্ছে। আমারাও বুঝতে পারছি যে, চ্যালেঞ্জটি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে নয়, বরং দীর্ঘদিনের চর্চায়, আমাদের ভ্রান্ত ধারণার কারণে সমাজে যে বাধাগুলো জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে সেগুলো পেরিয়ে যাওয়াই মূল চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা এখনও অনেক ক্ষেত্রে মৌলিক অধিকার পাওয়া থেকেই বঞ্চিত হচ্ছে। এর প্রধান কারণ হলো সমাজের অবহেলা, যা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করে।

একথা সত্য যে, প্রতিবন্ধিতা নিয়ে জীবন শুরু করা একটি কঠিন সংগ্রাম। এই লড়াই প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সবার পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। কেউ কেউ হয়তো চেষ্টা করেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, প্রতি ৪ জন প্রতিবন্ধী শিশুর মধ্যে মাত্র একজন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়। বাকি তিনজন এই সংগ্রামে পিছিয়ে পড়ে। সুতরাং নানা ধরনের কঠিন বাস্তবতার পথ পেরিয়ে একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে শিক্ষাজীবন শেষ করতে হয়। এরপর কর্মজীবনে প্রবেশ করার পালা। এখানেও চ্যালেঞ্জ কম নয়, কারণ অনেক চাকরিদাতাই আছেন যারা তাদের সক্ষমতা না দেখে শুধু সীমাবদ্ধতাগুলোকেই গুরুত্ব দেন।

এ ছাড়াও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, অবকাঠামোগত অসুবিধা ছাড়াও বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের অধিকাংশ কর্মক্ষেত্র এখনও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব হয়ে ওঠেনি। তবে, যখন কোনো প্রতিবন্ধী ব্যক্তি একটি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ প্রাপ্ত হন, তার চাহিদাগুলো তখন প্রতিষ্ঠানের কাছে পরিষ্কার হয়ে ওঠে। সেই কর্মস্থলটি ধীরে ধীরে তার জন্য উপযুক্ত হয় এবং সেখানে অন্যান্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্যও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ব্র্যাক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কর্মসংস্থান এবং সংবেদনশীল কর্মপরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। ব্র্যাকের মানবসম্পদ বিভাগে প্রতিবন্ধী কর্মীদের জন্য একটি নির্দিষ্ট তথ্যভান্ডার রয়েছে। যার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে, ব্র্যাকে ২৪৮ জন প্রতিবন্ধী কর্মী বিভিন্ন পদে নিয়োজিত আছেন। সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়োজিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কর্মসংস্থান মেলায় ব্র্যাক নিয়মিত অংশগ্রহণ করে আসছে। এর মাধ্যমে ব্র্যাকে একটি সিভি ভান্ডারও তৈরি হয়েছে, যেখানে আগ্রহী প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের তথ্য সংরক্ষিত রয়েছে।

ব্র্যাকে সাদিকুল ইসলাম (ছদ্মনাম) এর নিয়োগ প্রক্রিয়া কেমন ছিল সে গল্পটি বলতে চাই-

এই বছর শুরুতেই ব্র্যাকের নিরাপত্তা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বিভাগ ২০টি শূন্যপদে সেবা কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করে, যার মধ্যে ১৫টি সিকিউরিটি গার্ড, ৪টি সিসিটিভি অপারেটর এবং ১টি টেকনিশিয়ান ছিল। সিকিউরিটি কন্ট্রোল সেন্টারে যেন শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি কাজ করতে পারেন, সেই অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ সিসিটিভি অপারেটরের দায়িত্ব পুনঃমূল্যায়ন করে। এভাবে, কর্মক্ষেত্র প্রস্তুত হওয়ার পর, উপযুক্ত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য ব্র্যাকের ক্যারিয়ার সাইট এবং বিডি জবস-এ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। একইসঙ্গে ব্র্যাকের ‘জেন্ডার, জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি’ কর্মসূচির অধীন ডিজঅ্যাবিলিটি ইনক্লুশন ইউনিটের সহযোগিতা নেওয়া হয়।

ডিজঅ্যাবিলিটি ইনক্লুশন ইউনিটের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হলো, ব্র্যাকের বিভিন্ন কর্মসূচি ও বিভাগগুলোকে কারিগরি সহায়তা প্রদান করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ব্র্যাকে অন্তর্ভুক্ত করা। উপযুক্ত প্রতিবন্ধী প্রার্থী না পাওয়ায় ডিজঅ্যাবিলিটি ইনক্লুশন ইউনিট ব্র্যাক দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচির (এসডিপির) সঙ্গে সমন্বয় করে দুজন শারীরিক প্রতিবন্ধী প্রার্থী খুঁজে পায়। এর মধ্যে একজন স্বল্পমেয়াদি প্রকল্পে কাজ করেছিলেন এবং অন্যজন প্রশিক্ষণার্থী ছিলেন। তাদের দুজনকেই মৌখিক পরীক্ষার জন্য নির্বাচন করা হয়। পরবর্তীতে, নিয়োগ বোর্ড অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে সাদিকুল ইসলামকে চূড়ান্তভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

নিরাপত্তা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বিভাগ সাদিকুল ইসলামের কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এর মধ্যে রয়েছে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব কর্মপরিবেশ নিশ্চিত বিষয়ক প্রশিক্ষণ, সংবেদনশীল আচরণ করা ও প্রতিবন্ধী সহকর্মীর প্রতি সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব পোষণ করা, উপযুক্ত বসার ব্যবস্থা রাখা ইত্যাদি। পাশাপাশি, নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তির কর্মদক্ষতা উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। বর্তমানে সাদিকুল ইসলাম ব্র্যাক সিকিউরিটি কন্ট্রোল সেন্টারে কর্মরত আছেন।

আমরা জানি, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা সহজ কাজ নয়, তবে আমরা আন্তরিক হলে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন একসঙ্গে কাজ করার একটি সমন্বিত  উদ্যোগ, যা ব্র্যাকের নিরাপত্তা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ডিজঅ্যাবিলিটি ইনক্লুশন ইউনিট, মানবসম্পদ বিভাগ এবং দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচির সম্মিলিত প্রচেষ্টার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।

5 1 vote
ব্লগটি কেমন লেগেছে?