১৯শে মার্চ, ২০২০। হেড অফিস থেকে একটি চিঠি পেলাম। ভেবেছিলাম অফিস বন্ধ বা সাধারণ কোনো নোটিশ। কিন্তু চিঠি পড়েই মনে উদ্যম জেগে উঠল। চিঠিতে যে, করোনা দুর্যোগে মানুষের পাশে থেকে কাজের আহবান জানানো হয়েছে। মনে হলো, ডাক এসেছে যুদ্ধে যাবার!
আমি ব্র্যাকের মাইক্রোফাইন্যান্স কর্মসূচিতে কাজ করছি প্রায় ৩ বছর হতে চলল। কর্মস্থল ময়মনসিংহ, সেখানে আমি আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করছি।
“মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য”-কথাটি হয়তো সবাই জানি, কিন্তু মেনে চলি আর কজন বলেন? একবিংশ শতাব্দীর এই যান্ত্রিক জীবনে আমরা সবাই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকি। অন্যদের সমস্যা নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতে চাই না। করোনা মহামারির এই দুঃসময়ে কখনও কখনও তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর এসব দৃষ্টান্ত বারবার মানবতার দিকে আঙুল তোলে। করোনায় আক্রান্ত রোগীকে অপদস্থ করা, দোষারোপ করা বা মৃত ব্যক্তিকে রেখে পরিবারের সবাই পালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা সত্যিই দুঃখজনক।
একজন সচেতন নাগরিক, তদুপরি ব্র্যাককর্মী হিসেবে পত্রপত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও টেলিভিশনের এই খবরগুলো পড়ে ভাবছিলাম কেমন সমাজ? আমাদের কি কিছুই করার নেই? এই সব ভেবে একদিকে যেমন মুষড়ে পড়ছিলাম তেমনি কিছু একটা করার প্রচণ্ড তাগিদও অনুভব করছিলাম।
এ কারণেই যখন ব্র্যাকের চিঠি পেলাম তখন মনে হলো এটি আমার জন্য একধরনের ইচ্ছেপূরণের সুযোগ। অফিস-আদালত, দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গেল ঠিকই, কিন্তু আমরা থামিনি। আমরা পরিবারের কাছে ফিরে না গিয়ে ব্র্যাকের পক্ষে জনগণের পাশে দাঁড়ালাম। নিজের সিদ্ধান্তের কথা মাকে জানালাম। বললাম, আমি এই কাজের সাথে থাকতে চাই, তাই এই মুহূর্তে আর বাসায় ফিরছি না। আমার জন্য দোয়া কোরো। উত্তরে মা বললেন, “মা রে! তুই বাইরে কাজ করলে আবার-না তোরই অসুখ হয়ে যায়। তোর কিছু হলে আমি বাঁচব না।” মাকে বোঝালাম করোনার বিরুদ্ধে লড়াইটা আমাদের সবার। এসময় মানুষের পাশে থাকাই আমাদের কর্তব্য।
সরকার তখন সবেমাত্র সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। মানুষ সামাজিক দূরত্বের না মেনে দলে দলে বাড়িতে ফিরছিল। ঠিক করলাম, প্রথম কাজ হবে বাস-ট্রেন স্টেশন, হাট-বাজার ইত্যাদি জনসমাগম যেখানে বেশি হয় সেখানে মানুষকে সচেতন করা। আমাদের কর্ম-এলাকার এমন স্থানগুলো চিহ্নিত করে সেখানে কর্মীবাহিনীর ২০০ জনকেই নিয়োজিত করলাম সচেতনতামূলক লিফলেট ও স্টিকার বিলি করতে। অল্প দিনেই আমরা ৪৮০০০টি লিফলেট ও স্টিকার বিতরণ করলাম।
একই সাথে খেয়াল করলাম, হাট-বাজারে মানুষকে আসতেই হবে নিত্যপ্রয়োজনে। তাই ৯৫টি বিশেষ স্থান চিহ্নিত করে সেখানে সামাজিক দূরত্বরেখা আঁকলাম যাতে জরুরি প্রয়োজনে বাইরে আসা সকলে নিরাপদে তাদের কাজগুলো সারতে পারেন। আরেকটি বিষয় নজরে এলো। হাত ধোয়ার জায়গার অপ্রতুলতা। মোট ৮৫টি স্পটে আমরা হাত ধোয়ার ড্রাম ও সাবানের ব্যবস্থা করলাম।
বাজার বা বাণিজ্যিক এলাকা ছাড়াও আমার কর্ম-এলাকার ২৪টি ব্রাঞ্চের ৮টি উপজেলায় অলিতেগলিতে কুদ্দুস বয়াতির জনসচেতনতামূলক গানটি মাইকিং করা হলো। কর্মীদের নিয়ে সামাজিক দূরত্ব মেনে এলাকার মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়েছি হাতধোয়ার সঠিক নিয়ম শেখাতে, সচেতনতা বাড়াতে। এ সময় খেয়াল করলাম, অভাবগ্রস্ত মানুষের কাছে করোনার ভয় থেকে ক্ষুধার জ্বালা অনেক বেশি পীড়াদায়ক। সেই উপলব্ধি থেকে আমরা ব্র্যাকের ঋণগ্রহীতাদের মধ্য থেকে বিপন্ন ৪৭০০ জনকে ২০০০ টাকা করে দিয়ে তাদের খাদ্যের জোগান দেয়ার চেষ্টা করেছি।
জানি না পরিবার-পরিজন থেকে দূরে থেকে যে পরিশ্রম এবং লড়াই আমরা করছি তাতে সমাজের কোনো উপকার বা পরিবর্তন হবে কি না। ব্র্যাকের পক্ষ থেকে আমরা আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। তবে ভালো লাগে যখন দেখি, এই যুদ্ধে আমরা সবাই যে যার মতো চেষ্টা করে যাচ্ছি। যখন দেখি বিভিন্ন সংস্থা এতো আন্তরিকভাবে হতদরিদ্র পরিবারগুলোর আহার জোগাতে কাজ করছে, তখন আনন্দে মন ভরে যায়। যখন দেখি, কিছু মানুষ ভয় উপেক্ষা করে, নিয়ম মেনে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করে করোনা রোগীদের সবধরনের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, গর্বে বুক ভরে যায়। এইভাবে আমরা যদি যার যার জায়গা থেকে এগিয়ে আসি, তাহলে এই যুদ্ধে অবশ্যই জয়ী হব। শুধু তাই নয়, হয়তো একটি নতুন মানবিক সমাজ গড়ে তুলব আমরাই। করোনাকালে এই হোক আমাদের প্রাপ্তি।
অনুলিখন ও সম্পাদনা- সুহৃদ স্বাগত, তাজনীন সুলতানা, কামরান কাদের



