করোনাকালে রেডিও পল্লীকণ্ঠ: সহায়তা আর নির্ভরতায় পাশে আছে

তারিখ: 31 জান. 2021

লেখক: লীনা দিলরুবা শারমিন

রুমা বেগমকে দেখে আব্দুল শহীদ বললেন, ‘কিতা রেডিও আফা, বালানি?’ রুমা বেগম আমার দিকে তাকালেন। আমিও হাসিমুখে এগিয়ে গেলাম। রুমা বেগমের সাথে কথা বলতে বলতে মৌলভীবাজারের উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথে হাঁটছিলাম। পাহাড়ের ঢাল থেকে নেমেই এক বাড়ির বারান্দায় দেখা হলো আব্দুল শহীদের সঙ্গে। মিষ্টি রোদে বসে রেডিওতে গান শুনছেন।

তার রেডিও থেকে ভেসে আসছে গান- ‘করোনাভাইরাস থাকি বাছার লাগি দরকার ছাড়া বারে গোরাগোরি করবা না। মাস্ক পিনদইন। চউক, নাখ, মুকঅ হাত লাগানি বাদ দেইন। সাবান দিয়া একটু বাদে বাদে ২০ সেকেন্ড কইরা হাত দউকা। পয়লা হাতর তালুর মাঝে সাবান আর নাইলে হ্যান্ড ওয়াশ নিয়া…’

আজকাল রুমা বেগমকে অনেকেই ‘রেডিও আপা’ বলে ডাকছেন। তিনিও হেসে জবাব দিচ্ছেন।

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার কালেঙ্গা গ্রামের ব্র্যাক স্কুলের শিক্ষিকা রুমা বেগম। ব্র্যাক প্রাক-প্রাইমারি স্কুলে পড়ান। ২০১২ সালে ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছেন। আজকাল রেডিও পল্লীকণ্ঠের সুবাদে রুমা আপা শুধু নিজ স্কুলেই নয়, আশেপাশের অনেক শিক্ষার্থীর প্রিয় শিক্ষক হয়ে উঠেছেন। কীভাবে তা সম্ভব হলো সে বিষয়ে আলাপের এক পর্যায়ে তার এই ‘রেডিও আপা’ হয়ে ওঠার কারণ জানার সুযোগ পেলাম।

মৌলভীবাজার জেলায় ব্র্যাকের কমিউনিটি রেডিও স্টেশন হিসেবে ‘রেডিও পল্লীকণ্ঠ’ যাত্রা শুরু করে ২০১১ সালে। বর্তমানে ১১টি উপজেলার জনসাধারণ রেডিও পল্লীকণ্ঠের অনুষ্ঠানমালা শুনতে পান। কোভিড মহামারির দুঃসময়ে আঞ্চলিক ভাষায় জনগণের কাছে সচেতনতামূলক বার্তাগুলো পৌঁছে দিচ্ছে রেডিও পল্লীকণ্ঠ।  কোভিডকালীন নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা, অনুষ্ঠান প্রচার, গণসচেতনতা, সরকারি নির্দেশনা প্রচার এবং তা আঞ্চলিক ভাষায় পুনঃপ্রচারসহ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে রেডিও পল্লীকণ্ঠ যেন তার পূর্বের খ্যাতিকে ছাপিয়ে ভরসা ও বিনোদনের উৎস হিসেবে আরও আপন হয়ে উঠেছে মৌলভীবাজারের মানুষের কাছে। কতটা? তা একটা ছোট্ট উপাত্তের মাধ্যমেই তুলে ধরা যাক।

২০২০ সালের মার্চের ১২ তারিখ থেকে ২০২১ সালের জানুয়ারির ১৩ তারিখ পর্যন্ত এক বছরের কম সময়ে রেডিও পল্লীকণ্ঠ তাদের কিছু নির্দিষ্ট অনুষ্ঠান নিজেদের ফেসবুক পেইজে অডিও লাইভের মাধ্যমে প্রচার করেছে। এখন পর্যন্ত ৫৬২টি অনুষ্ঠান ফেসবুক অডিও লাইভে প্রচারিত হয়েছে এবং এসব পোস্ট পৌঁছে গেছে সাড়ে ৮ লাখেরও বেশি মানুষের কাছে।

করোনা মহামারির প্রভাবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নানা ধরনের সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। বর্ষব্যাপী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ঘরবন্দি সময় কাটাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। তাদের শরীর ও মনের বিকাশের জন্য এবং শিক্ষার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে রেডিও পল্লীকণ্ঠ শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান সম্প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছে। লকডাউন ও তার পরবর্তী সময়ে নারীর ওপর বাড়তি কাজের বোঝা এবং পারিবারিক সহিংসতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গিয়েছে। তাই নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে প্রচারিত হচ্ছে বিশেষ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান। এছাড়াও বাল্যবিবাহ রোধ ও যৌন হয়রানি নির্মূলে সম্প্রচার করা হচ্ছে রেডিও নাটক।

মহামারিতে সুস্থ থাকতে রেডিও পল্লীকণ্ঠের ফোন লাইভে সরাসরি প্রশ্নোত্তর পর্বের অনুষ্ঠানে আসছেন স্থানীয় সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসকবৃন্দ। কিশোরীদের পুষ্টি ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার নানা বিষয়ে তারা আলোচনা করছেন। শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কেও এলাকাবাসী কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন অন্য আরেকটি অনুষ্ঠানের ফোন লাইভে।

ছয় বছরের কম বয়সি শিশুদের জন্য ব্র্যাক রেডিও পল্লীকণ্ঠের পক্ষ থেকে প্রচারিত হচ্ছে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান। নাম, রেডিও স্কুল। সঞ্চালকের সাথে থাকেন দুইজন শিক্ষার্থী আর রুমা বেগম। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই তিনি আজ রেডিও আপা।

রুমা বেগম বললেন, ‘আমি পরিচিত হয়েছি ক্লাস নেওয়ার জন্য। কিন্তু করোনাকালীন রেডিও পল্লীকণ্ঠে প্রচারিত অনেক অনুষ্ঠানের সঞ্চালক এবং আগত অতিথিরাই হয়ে উঠেছেন জনপ্রিয়, দুঃসময়ের বন্ধু। পরিবারের সবাই বাড়িতে থাকায় অনেকেই পছন্দ অনুযায়ী টেলিভিশন দেখার হয়তো সুযোগ পান না, কিন্তু নিজের মোবাইলে রেডিও শুনতে পারছেন।’

কোভিডকালীন যেসব সরকারি নির্দেশনা এসেছে সেসব রেডিও পল্লীকণ্ঠ নিয়ম মেনে প্রচার করছে। বিশ সেকেন্ড ধরে সাবান ঘষে হাত ধোয়া, বাধ্যতামূলক মাস্ক পরিধান এবং মাস্ক ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা, আইসোলেশন, স্থানীয় জেলা প্রশাসকের নির্দেশনা প্রচার, বয়স্কদের সুস্থতার জন্য করণীয়, মানসিক চাপ থেকে রক্ষার বিষয়গুলো নিয়ে স্থানীয় ভাষায় সম্প্রচারিত হচ্ছে রেডিও নাটক। সেইসঙ্গে স্বাস্থ্যসেবার জরুরি নম্বর এবং সরকারি ওয়েবসাইটসমূহ সম্পর্কে জনসাধারণকে অবহিত করছে রেডিও পল্লীকণ্ঠ। এমনকি করোনার সময়ে ছিল বোরো ধান কাটার মৌসুম। সে সময় স্থানীয় জনগণকে ধান কাটা থেকে শুরু করে সংরক্ষণ পর্যন্ত সকল প্রকার নির্দেশনা নিয়মিত প্রচার করেছে।

আব্দুল শহীদ ক্যামেরায় তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে বললেন, ‘আগর কতা মন অর। যেসময় রেডিও হুনিয়া সারা দেশর খবর পাইতাম। অখন দেশর খবরর লগে লগে নিজর এলাকার খবরও ফাই। খুব বালা লাগে।’ (আগের সময় মনে পড়ে। যখন রেডিও শুনে দেশের খবর পেতাম। এখন দেশের খবরের পাশাপাশি নিজের এলাকার খবরটাও পাই। খুব ভালো লাগে।)

 

সম্পাদনা- তাজনীন সুলতানা

5 1 vote
ব্লগটি কেমন লেগেছে?