কর্মজীবনের পথচলা অনেকটা নদীর মতো—আঁকাবাঁকা, বৈচিত্র্যময়। এই পথের প্রতিটি বাঁকে লুকিয়ে থাকে নতুন নতুন গল্প। কিছু সাফল্যের, কিছু ব্যর্থতার। আর কিছু গল্প আছে যা আমাদের শেখায় জীবন সবসময় পরিকল্পনামাফিক সরল পথে চলে না। কখনও কখনও তার নিজের মতো চলে। আমার পেশাগত জীবনের গল্পটাও এর চেয়ে ব্যতিক্রম নয়। বরং নারী হিসেবে এই পথচলা কখনোই শুধু আমার কর্মদক্ষতার পরীক্ষা ছিল না, ছিল নিজের স্বপ্ন আর দায়িত্ববোধের মাঝে ভারসাম্য খুঁজে নেওয়ার এক অবিরাম প্রয়াস। এই পথচলার মাঝেই একসময় এসে দাঁড়াই এক মোড়ে। এক অনন্য সুন্দর, অথচ জীবন বদলে দেওয়া এক বাঁকে যার নাম মাতৃত্ব।
রবার্ট ফ্রস্টের The Road Not Taken কবিতার মতোই মাতৃত্ব আমাকে এনে দাঁড় করায় দুটি পথের সন্ধিক্ষণে। একদিকে মা হয়ে সন্তানের বেড়ে ওঠা কাছ থেকে দেখার লোভ। অন্যদিকে একজন উন্নয়নকর্মী হিসেবে মানুষের জন্য কাজ করার অদম্য তাড়না। সংশয়, দ্বিধা, আর টানাপোড়েন পেরিয়ে অবশেষে আমি কর্মবিরতির সিদ্ধান্ত নিই। অর্থনীতির ‘অপারটুনিটি কস্ট’-এর সূত্র মেনে ডোনার মিটিংয়ের জায়গায় খেলার রঙিন ব্লক, রিপোর্টিং ডেডলাইনের বদলে বেডটাইম স্টোরিজ, আর থিওরি অব চেঞ্জের বিশ্লেষণ ফেলে আমি বেছে নিই সেই অনন্য মুহূর্তগুলোকে, যেখানে আমার সন্তান প্রতিদিন একটু একটু করে পৃথিবী আবিষ্কার করছে। আগে যেখানে সময় কাটত প্রজেক্ট আপডেট আর স্ট্র্যাটেজিক মিটিংয়ে, এখন সেখানে দিন শুরু হয় কৌতূহলী চোখের হাজারও প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মধ্য দিয়ে।
জীবনের এই নতুন অধ্যায় আমাকে শিখিয়েছে ধৈর্যের আসল রূপ, শিখিয়েছে প্রতিটি মুহূর্তের গভীরতা অনুভব করতে, শিখিয়েছে লক্ষ্য ঠিক রাখতে। তবে সেই লক্ষ্যকে নতুন আলোয় দেখার মানসিকতা থাকতে হবে। আগে লক্ষ্য ছিল সমাজ পরিবর্তনের নকশা আঁকা, আর এখন তার সঙ্গে জুড়েছে আরও একটি সুন্দর দায়িত্ব—এক জোড়া জিজ্ঞাসু চোখের সামনে পৃথিবীর দরজা খুলে দেওয়া, তাকে ভালোবাসার ভাষা শেখানো, তাকে নিজের মতো করে জীবনের রঙ খুঁজে নিতে দেওয়া।
প্রচলিত ধারণায় কর্মজীবী নারীদের জীবনের এই সন্ধিক্ষণের পোশাকি নাম (কর্ম)বিরতি, তবে এই বিরতি কোনো থেমে থাকা নয়। বরং এটি নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলার এক অধ্যায়। মাতৃত্ব আমাকে এমন সব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে, যা কোনো কর্পোরেট লিডারশিপ ট্রেনিং শেখাতে পারত না। তাই মাতৃত্ব কেবল একটি সম্পর্ক নয়, এটি এক নতুন যাত্রা—যেখানে প্রতিটি দিন শেখার, ধৈর্য ধরার, আর নতুন বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার এক অনুশীলন।
কখনও দায়িত্বের ভারে ক্লান্তি আসে। কখনও ছোট ছোট অর্জনে হৃদয় ভরে যায়। কখনও মনে হয় সবকিছুই পরিকল্পনার বাইরে চলে যাচ্ছে, আবার কখনও জীবনের এই বিশৃঙ্খল সৌন্দর্যকেই আলিঙ্গন করতে ইচ্ছে করে। এই পথচলায় আমি বুঝেছি সবসময় সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না, কিন্তু ভারসাম্য খুঁজে নেওয়া সম্ভব। সময়, অগ্রাধিকার আর নিজের চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে এক সূক্ষ্ম সমঝোতা গড়ে তোলার নামই জীবন। সেটা হোক ব্যক্তি কিংবা কর্মজীবন।

সহকর্মীদের সঙ্গে
তাই প্রায় ১৮ মাস পর যখন আমি আবার কর্মজীবনে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছি তখন ফিরছি এক নতুন জীবন দর্শন নিয়ে। যেখানে শুধু একজন উন্নয়নকর্মীর অভিজ্ঞতাই নয়, বরং একজন মায়ের জীবনমুখী সব চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে ওঠার পারদর্শিতাও সঙ্গে নিয়ে আসছি। আর আমার এই ফিরে আসার গল্পে ব্র্যাকের ব্রিজ রিটার্নশিপ প্রোগ্রাম আমাকে নতুন করে শুরু করার এক অনন্য সুযোগ এনে দিয়েছে—নিজেকে আবার কর্মজীবনে খুঁজে পাওয়ার, নিজের জায়গাটা ফিরে পাওয়ার।
কখনও কখনও বিরতি নেওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এই বিরতি মানে থেমে থাকা নয়, বরং নতুনভাবে প্রস্তুত হওয়া। এখন আমি যখন ফিরছি তখন শুধু পূর্বের কর্মক্ষেত্র থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতাই সঙ্গে আনছি না, আনছি নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন এক মানসিকতা। মাতৃত্ব আমাকে শিখিয়েছে জীবনকে শুধু পরিকল্পনার কাঠামোতে বাঁধা যায় না, কখনও কখনও জীবন নিজেই নতুন পথ দেখিয়ে দেয়। তাই এবার আমার ফেরা কেবল নিজের জায়গায় ফিরে আসা নয়, বরং আরও আত্মবিশ্বাসী, আরও পরিণত এবং নতুনভাবে গড়ে ওঠা এক ‘আমি’র যাত্রা শুরু করার।



