একটি গরুর জন্য…

তারিখ: 21 অক্টো. 2017

লেখক: সুহৃদ স্বাগত

এরপর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে আব্দুর রহিম তার মোটরবাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। অন্ধকার, ফাঁকা রাস্তা ধরে তিনি বাইক নিয়ে সতর্কভাবে ছুটতে থাকেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনাস্থলে পৌছে তিনি দেখতে পান ওই সদস্যের পরিবারের সবাই দিশেহারা প্রিয়, হারিয়ে যাওয়া গরুটিকে সবাই পাগলের মতো এদিক ওদিক খুঁজছে। গরুটি তো তাদের পরিবারের একজন সদস্যের মতোই।

‘বিশ্বাস করেন রহিম ভাই আশেপাশে সব জায়গা খুঁজে দেখছি কোথাও নাই।’ লোকটি অস্থিরভাবে বলতে থাকেন, ‘এখন আমি কি করুম কন ভাই।’

গভীর রাতে এমন এক কঠিন পরিস্থিতি। এ সময় কার কীইবা করার থাকে?

আব্দুর রহিমের মাথায় হঠাৎ বিদ্যুৎচমকের মতো একটা আইডিয়া খেলে গেল। নিকটস্থ মসজিদে গিয়ে তিনি ঘুমন্ত মুয়াজ্জিনকে ডেকে তুললেন। তাঁকে অনুরোধ করলেন তিনি যেন মসজিদের মাইক ব্যবহার করে গরু হারিয়ে যাওয়ার খবরটি নিজ কন্ঠে আশেপাশের সবাইকে জানান। এখনই।

মুয়াজ্জিন সাহেব অনুরোধ রাখলেন। ভোর চারটায় এলাকাবাসী শুনল সেই অভিনব ঘোষণা! “ব্র‍্যাকের একজন সদস্যের একটি গরু চুরি গেছে। সবাইকে খোঁজ করার জন্য অনুরোধ জানানো যাচ্ছে।”

বিজ্ঞপ্তিটি কাছাকাছি এলাকার আরও চারটি মসজিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হলো। ফজরের নামাজের ঠিক আগে আগে তারা নিজেরাও উদ্যোগী হয়ে এই বিজ্ঞপ্তি প্রচার করতে লাগল।

দ্রুত খবর ছড়িয়ে পড়লো আশেপাশের ব্র‍্যাক অফিসগুলোতেও। কর্মীরা তাদের বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন এবং একযোগে আখখেত এবং ধানখেতের মধ্যে গরুটি খুজতে লাগলেন।

সবার মনে একটাই প্রশ্ন, কোথায় গেল গরুটা?

অবশেষে, কিছু সময় পর আব্দুর রহিম অচেনা নম্বর থেকে একটি ফোন পান। ফোনের ওপাশ থেকে একজন দাবি করলেন তিনি একটি গরুকে কাছেই একটি আখখেতে ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন। সবাই আখখেতে ছুটে গেল এবং গরুটিকে উদ্ধার করা হলো। অবস্থাদৃষ্টিতে বোঝা গেলো, চারপাশের গণঘোষণায় আতঙ্কিত হয়ে রাস্তার পাশে একটা গাছের সঙ্গে গরুটিকে বেঁধে রেখে চোর মহাশয় দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেছেন।

গত ১১ বছর ধরে ব্র্যাকের অতিদরিদ্র কর্মসূচির সঙ্গে আছেন আব্দুর রহিম। এরকম কত অভিজ্ঞতাই-না জমা হয়েছে তার এতদিনের সংগ্রামময় জীবনে। ২০০৭ সালে ব্র্যাকে যোগদানের পূর্বে তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিপণন প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তিনি যখন গাজীপুরে একজন ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হিসেবে যোগদান করেন, ব্র্যাক সম্পর্কে তাঁর ধারণা তখন খুব সামান্য। তবে একটি ব্যাপারে তাঁর চিন্তাভাবনা খুব স্পষ্ট ছিল, তিনি মানুষের কল্যাণে কাজ করতে চান। একদিন একটি গ্রামে ভিজিটে গেলে তাঁর সঙ্গে একজন বৃদ্ধার পরিচয় হয়। গত দুদিন ধরে তিনি খাবার খান নি। সেদিন আব্দুর রহিম উপলব্ধি করেন, তাঁর কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সঙ্গে সঙ্গে কাছের একটি দোকানে বৃদ্ধাকে নিয়ে যান এবং কিছু খাবার কিনে দেন। খাবার পেয়ে বৃদ্ধা আব্দুর রহিমকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন আর বারবার দোয়া করতে লাগলেন। তারপর থেকে আব্দুর রহিম মানুষের কল্যাণে নিজেকে আরও গভীরভাবে নিয়োজিত করলেন।

“আমার নিজের হয়তো সেই সঙ্গতি নেই যা দিয়ে কোটি মানুষের জীবন বদলে দেয়া যাবে”, আব্দুর রহিম বলতে থাকেন, “কিন্তু আমার আশে পাশে যে হাজারো দুস্থ মানুষের বাস তাদের জীবন তো বদলে দেওয়া যেতে পারে। কোন কাজই ছোট নয়। আমি সবসময় মনে করি যে আমি অনেক বড় কোনোকিছুর একটি অংশ।”

তাঁর এলাকার ব্র্যাক সদস্যদের যে কোন প্রয়োজনই আব্দুর রহিম মেটাবার চেষ্টা করেন। রাত তিনটার সময় গরু হারিয়ে যাবার মতো ঘটনা ঘটলেও তিনি তখনই বাইরে বেরিয়ে আসেন।

আব্দুর রহিম এখন ঠাকুরগাঁওয়ের রিজিওনাল ম্যানেজার। ২০০৭ সাল থেকে তিনি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রায় ৮,০০০ সদস্যের সঙ্গে কাজ করেছেন। তাদেরকে তিনি গ্র্যাজুয়েট হয়ে আত্মসমৃদ্ধির পথ অর্জন করতে দেখেছেন। তাঁর কাছে এটিই সবচেয়ে বড় গর্বের বিষয়।

1 1 vote
ব্লগটি কেমন লেগেছে?