এই রায় হোক দৃষ্টান্ত

তারিখ: 12 ফেব. 2018

লেখক: সুহৃদ স্বাগত

১২ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮।

মৃত্যুর ১৭৩ দিন এবং মামলা গ্রহণের ১৭১ দিন পর পুরুষ কর্তৃক সংঘটিত এক বর্বরোচিত, নৃশংসতম অপরাধের বিচারের রায় আজ ঘোষিত হলো। সেই রায়ে রূপা ধর্ষণ এবং হত্যা মামলার দায়ে অভিযুক্ত পাঁচজন ধর্ষকের একজনও অভিযোগ থেকে মুক্তি পাননি।

আমরা প্রতিনিয়তই বাসে চলাফেরা করি, নারীপুরুষ নির্বিশেষে। কখনও একা, কখনও কারো সাথে। আবার কখনও পুরো বাসে একা।

২৫ আগস্ট, ২০১৭। বগুড়া থেকে ময়মনসিংহগামী ছোঁয়া পরিবহনের একটি বাসে চাকুরির পরীক্ষা দিয়ে ফিরছিলো প্রত্যয়ী, স্বাবলম্বী, নিজের ক্যারিয়ার গড়তে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রূপা। জীবনসংগ্রামের কাছে হার না মেনে দীর্ঘদিন ধরে একাই নিজেকে গড়ে তুলেছে সে, এক সুন্দর ভবিষ্যতের আশায়।

সেই রাতে তার স্বপ্ন ধ্বংস করতে ধেয়ে এলো পাঁচ জন পুরুষ। এক বিষাক্ত ছোঁবলে নিঃশেষ হয়ে গেল তার সমস্ত আশা, আকাঙক্ষা; রাজপথে ধুলোর সাথে মিশে রইলো তার স্বপ্ন আর পৌরুষের লজ্জা।

দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে একজন পুরুষের রয়েছে বিভিন্ন ভূমিকা, বিভিন্ন রূপ। নারীকে সহযোগী বা সহচরী মানতে তাদের বড্ড আপত্তি। অনেকের কাছে তো নারী কেবল ভোগ্যবস্তু ছাড়া আর কিছুই নয়। এই আধুনিক, সভ্য সময়েও পুরুষ যেসব বর্বরোচিত আচরণ, যেসব পাশবিক নির্যাতনে নারীকে জর্জরিত করেন তাতে প্রশ্ন জাগে পুরুষের মানসিকতা নিয়ে, মনুষ্যত্ব নিয়ে। রূপার উপর যে নির্যাতন সেদিন রাতে চলন্ত বাসে ঘটে গেল, তা যেন পুরুষের নিষ্ঠুরতার এক ভয়াবহ দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো।

অভিযুক্ত ধর্ষকদের ৫ জন ৫ বয়সী। তাদের বয়স যথাক্রমে ১৯, ২৬, ৩৫, ৪৫, ৫৫। বাস্তবে বয়স অনুযায়ী এই পুরুষদের কেউ রূপার ছোট ভাইয়ের বয়সী, কেউ হয়তো সমবয়সী, কেউ বড় ভাই, আবার কেউবা মুরুব্বী স্থানীয়। নিশ্চয়ই তাদেরও পরিবার পরিজন রয়েছে। রয়েছে মা, বোন, স্ত্রী, কন্যা।

কিন্তু যে পুরুষ ধর্ষক, সে আত্মীয় চিনতে শেখেনি। মা, বোন, স্ত্রী, কন্যার মূল্য সে জানে না। সে চেনে কেবল নারী। আর নারীদেহের উপস্থিতি মাত্রই তার কামনার জাগরণ ঘটে।

হায় পুরুষ! ছলে বলে কৌশলে যার মন পেতে চায়, যাদের সৌন্দর্য্যে উপচে পড়া কবিতার স্রোত জাগে হৃদয়ে, তাদেরই আবার কিনা সে হায়নার মতো ছিঁড়েক্ষুরে খেয়ে ঘাড় মটকে ফেলে দেয় রাজপথে।

ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচি প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৮১২টি। তার মধ্যে ০-১৭ বছর বয়সী নারীদের ৫৬০টি ধর্ষণ, গণধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হতে হয়েছে।

ধর্ষণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজসৃষ্ট এক মহামারী। আর এই মহামারীতে আক্রান্ত পুরুষের অবস্থান সমাজের প্রতিটি কোণে। এদের দেখলে চেনা যায় না, কিন্তু এরা ওঁত পেতে থাকে। যখন শিকার চিহ্নিত হয়, তখন ঝাঁক বেঁধে তার উপর এরা ঝাপিয়ে পড়ে। আর এদের নির্মম আক্রমণে একসময় জীবনপ্রদীপ নিভে আসে সেই নারীর। তাকে ভোগ করে হিংস্র উন্মাদনায় ফেলে দেয় আবর্জনার মতো।

মৃত্যুর দুই দিন পর পত্রিকায় ছবি দেখে আরেকজন পুরুষকে নিজের বোনের মৃতদেহ গ্রহণ করতে যেতে হয়। বোন কাজে গিয়েছিল, বলে তো যায়নি যে আর ফিরবে না! দুইদিন নিখোঁজ থাকার পর যখন পুরুষকে নিজের বোনের, নিজের মেয়ের এই করুণ মৃত্যু সংবাদ জানতে হয়, তখন তারা কাকে দোষ দেবে নিজের সমাজকে ছাড়া? সেও তো পুরুষ, সেও তো শক্তিশালী। কিন্তু প্রিয় মানুষটিকে কি তারা বাঁচাতে পারলো? এই পাশবিকতার কাছে ঘটে গেছে পৌরুষের পরাজয়, মানবতার পরাজয়।

পুরুষ হিসেবে যার যার অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে আমরা আবারও আহবান করছি সকল পুরুষদের। এই বিচার দেশের ইতিহাসে উদাহরণ হয়ে থাকুক। হয়তো আরও আগে থেকে এমন কড়া পদক্ষেপের ব্যবস্থা সক্রিয় থাকলে রূপা সেদিন হয়তো হাসিমুখেই বাড়ি ফিরতো, মায়ের সাথে খেতে বসতো। পরের দিন স্বপ্নময় চোখে আবার বেরিয়ে পড়তো পথে। নিরাপদে।

‘পাশবিকতার নির্মমতায় যারা কেড়ে নিয়েছিল প্রাণ

তাদের প্রশ্রয়ভূমি যেন হয়ে না ওঠে এই পৃথিবীর কোন স্থান’

0 0 votes
ব্লগটি কেমন লেগেছে?