আলপিনার জীবনমঞ্চ

তারিখ: 13 জুল. 2017

লেখক: সুহৃদ স্বাগত

নেত্রকোণা জেলার নূরপুর গ্রামের বাসিন্দা আলপিনা বেগমকে নিয়ে আজকে আমাদের এই গল্প। এটি একজন সাধারণ মানুষ থেকে অসাধারণ এক শিল্পী হয়ে ওঠার গল্প।

সারাদিন নানা কাজে দিন কাটে আলপিনা বেগমের। নিজের করা ছোট বাগানটায় বিভিন্ন সবজির পরিচর্যা, হাঁস-মুরগী ও ষাঁড়ের খাবার দেয়া এবং সবশেষে তার তিন মেয়ের জন্য রান্নাবান্না- প্রতিদিন এই একই রুটিন।

এরপর বিকেল ঘনিয়ে সন্ধ্যা আসে, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত- আর রাতকে ঘীরেই চলতে থাকে আলপিনা’র প্রস্তুতি, স্বপ্ন। তার জন্য মঞ্চ থাকবে প্রস্তুত, একেকটি রাত যেন আলোকিত হয় আলপিনা বেগমের ছড়িয়ে দেয়া রঙ্গিন আলোয়!

আলপিনার আছে একটি বিশেষ ব্যাগ, যা তার কাছে খুবই মূল্যবান! সেই ব্যাগ থেকে একটি সালোয়ার কামিজ বের করেন এবং নিজের পরণের শাড়িটি বদলে নেন। কিছু চুড়িও তিনি ব্যাগ থেকে বের করে পড়ে নেন। আসলে, আলপিনা তার গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষ নিয়ে গঠিত স্থানীয় একটি গণনাটক দলের সদস্য এবং তার দলের সাথে তিনি আশেপাশের বিভিন্ন এলাকায় নাটকের মঞ্চায়নে অংশ নেন।

মঞ্চে উঠে আলপিনা যেন এক অন্য মানুষ। তার দৃপ্ত, আশাবাদী কন্ঠস্বরে মানুষ শুনতে পায় মানবতা ও সাম্যের জয়গান, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিচারের দাবি ও একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ার আহবান। তার কন্ঠে হুঁশিয়ারি শোনা যায় নারী নির্যাতন ও বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে।

সমাজের অবিচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে প্রাচীন গ্রীসে শুরু হয়েছিল বিভিন্ন নাটকের মঞ্চায়ন ও সংলাপ। একসময় বাংলাদেশেও গণনাটক ছিল ভীষণ জনপ্রিয়। আজও প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ দেশের আনাচে কানাচে মঞ্চায়িত বিভিন্ন গণনাটক উপভোগ করেন। এই গণনাটকগুলোর জনপ্রিয়তার পেছনে মূল কারণ, এর গল্পগুলো মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ, সত্য ঘটনা অবলম্বনে এবং অঞ্চলভেদে অভিনেতা ও নির্দেশকগণ গল্পগুলোকে স্থানীয় ভাষায় ও ভাবধারার মাধ্যমে দর্শকদের মাঝে ফুটিয়ে তোলেন।

নেত্রকোনায় গণনাটকের দর্র্শক

আলপিনা ও তার দলের নাটকগুলোয় সামাজিক অবিচার ও নির্যাতনের করুণ গল্পগুলো বাস্তব হয়ে ফুটে ওঠে। মঞ্চে তার শক্তিশালী ও প্রাণবন্ত উপস্থিতি দিয়ে তিনি প্রতিনিয়ত দর্শকদের বুঝিয়ে দেন যে এই গল্পগুলো তার জীবনের কথা; আজ দর্শকরা যা দেখছে তাকে একসময় এসব কঠিন সময়ের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। তার স্বামী তাকে এবং তার তিন কন্যা সন্তানকে ফেলে সংসার ছেড়ে চলে গিয়েছিল। এমন এক পরিস্থিতিতে অভাবের তাড়নায় অন্য এক পরিবারের সাথে একটি মাত্র ছোট ঘরে তিনটি শিশুসহ মানবেতর জীবনযাপনে আলপিনা বাধ্য হয়েছিলেন।

স্বামীর হাতে তাকে বহুবার শারীরিকভাবে নির্যাতিত হতে হয়েছিল। এসব ঘটনার বহুদিন পর তিনি জানতে পারেন যে এধরণের আচরণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আলপিনা মূলত দু’টি কারণে বহুদিন মুখ বুঁজে এসব অত্যাচার সহ্য করেছিলেন। একটি কারণ, তিনি কখনোই জানতেন না কি করে এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হয় এবং দ্বিতীয় ও প্রধান কারণ হলো নিজের অধিকার বলতে যে তার কিছু আছে এই ব্যাপারেই কেউ তাকে কখনও সচেতন করেনি। তার গ্রামের এক উন্নয়নমূলক সংস্থার মাধ্যমে তিনি এসব বিষয় সম্পর্কে জানতে পারেন এবং অবশেষে একদিন তিনি তার স্বামীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী হন।

আলপিনা বেগম তার শৈশবে আরও অনেক কিছুর মত ছিলেন লেখাপড়া থেকেও বঞ্চিত। তার মতো যেন তার মেয়েরা শিক্ষার অভাবে না ভোগে সে ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তাই নিজের কৃষিকাজ এবং অভিনয় থেকে যখন আয় করতে শুরু করলেন তখনই দেরী না করে তিন মেয়েকেই তিনি স্কুলে ভর্তি করে দেন। এটাই ছিল নিজের আয় থেকে তার প্রথম সূদুরপ্রসারী বিনিয়োগ।

দেশের ৪৩০টি গণনাটক দলের প্রায় ৪৩০০ নাট্যকর্মীর মধ্যে আলপিনা বেগম একজন। নিজের চেষ্টায় অভিনয় প্রতিভা বিকশিত করে শত বাঁধা এবং সংগ্রামের পর আজ ধীরে ধীরে তিনি নিজের জন্য একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পেরেছেন। এই যাত্রাদলগুলোতে কাজ করেন লোকশিল্পী, শিক্ষক, ডাক্তার, ছাত্র-ছাত্রী, গৃহবধূ ইত্যাদি বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ যারা একটি সুন্দর সমাজ গড়বার স্বপ্ন দেখেন। শিল্পকে একটি বৈষম্যহীন সমাজ গড়বার হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগিয়ে তারা সামাজিক অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন; এবং তারা আশাবাদী, জয় একদিন তাদের হবেই।

আলপিনার জীবনটা মঞ্চ নয়, সংগ্রামের সাথে তার জীবনের গল্প তাকে প্রতিনিয়ত নতুন করে লিখতে হয়েছে। মঞ্চে তার অভিনয়ে দর্শকরা কখনও বা টান টান উত্তেজনা অনুভব করেন, কখনও বা হাসেন আবার কখনও ভিজে ওঠে তাদের চোখের কোণ। দিনশেষে, আলপিনা তার সন্তানদের চোখে দেখতে পান মা’কে নিয়ে কি ভীষণ গর্ব তাদের!

0 0 votes
ব্লগটি কেমন লেগেছে?