আমাদের যুদ্ধ

তারিখ: 28 মে 2020

লেখক: শামীম আহম্মেদ

করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ আজ শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে আলোচিত শব্দ। এটি একপ্রকার ভাইরাসজনিত অসুখ, যার এখনও পর্যন্ত কোনো প্রতিরোধক আবিষ্কৃত হয়নি। প্রতিদিনই বিশ্বে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে।

বাংলাদেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হয় গত ৮ই মার্চ। এরপর থেকেই করোনাভাইরাসের ভয়াল থাবা ধীরে ধীরে গ্রাস করতে থাকে গোটা দেশকে।

প্রথমদিকে অনেকেই এর ভয়াবহতা সম্পর্কে শুনলেও সেদিকে গুরুত্ব দেননি। প্রথম যখন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয় তখন দলে দলে মানুষ গ্রামের বাড়ি যাওয়া শুরু করে। মনে হয় যেন ঈদের ছুটি উপভোগ করতে চলেছে সবাই।

বিস্ফোরণের মতো ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হলো। এমন মুহূর্তে জনগণকে সচেতন করতে মাঠে নামে ব্র্যাক। মূলত ২১ই মার্চ থেকেই সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করার কাজ শুরু করি আমরা। এরপর পরিস্থিতির প্রয়োজনে ধীরে ধীরে তা বিস্তৃতি লাভ করে। শুরু হয় কুদ্দুস বয়াতির গাওয়া সচেতনতামূলক গানের মাইকিং, যা খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে। এছাড়াও বাজারের দোকানে দোকানে সামাজিক দুরত্ব রক্ষার জন্য বৃত্ত অংকন করা, হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে মানুষের হাত জীবাণুমুক্তকরণ ইত্যাদি।

আমি ব্র্যাক মাইক্রোফাইন্যান্সে এলাকা ব্যবস্থাপক হিসেবে চাঁদপুরের ছেংগারচরে কর্মরত আছি।   ২৭শে মার্চ দুপুরের দিকে কাজ শেষে বাসায় ফেরার সময় কিছু বাজার করি। বাজারের পরিমাণ একটু বেশিই ছিল, উদ্দেশ্য যাতে বেশ কিছুদিন বাজারের ভিড় এড়িয়ে চলা যায়। মালামাল বেশি থাকায় রিকশা নিলাম বাসায় ফেরার জন্য। রিকশায় উঠতে গিয়ে হঠাৎ মনে হলো, রিকশায় আমার আগে যদি কোনো করোনা রোগী উঠে থাকে তবে তো সংক্রমণ আমার মধ্যেও ছড়াতে পারে। আর এভাবে যতো লোক ঐ রিকশায় উঠবে সবাই সংক্রমিত হবে।

বাসায় ফিরেও এই ভাবনা আমায় তাড়িয়ে বেড়াতে লাগল। ভালো করে সাবান মেখে গোসল করলাম, যাতে শরীরে জীবাণু না থাকে। পরনের কাপড়গুলোও ঘণ্টাখানেক সাবানপানিতে চুবিয়ে রেখে ডেটলপানিতে জীবাণুমুক্ত করে ধুয়ে নিলাম। শরীর আর কাপড়ের জীবাণু গেল কি না জানিনা তবে মাথার মধ্যে যে জীবাণুর চিন্তা ঢুকেছিল তা বাড়তেই লাগল। চিন্তা করতে করতে হঠাৎই আইডিয়াটি মাথায় এলো।

কেমন হয় যদি বাজারের সকল গণপরিবহণে জীবাণুনাশক ছিটিয়ে জীবাণুমুক্ত করা যায়? যা ভাবা তাই কাজ। পরদিন সকালে আমাদের কমিউনিটি অর্গানাইজারদের (সিও) সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলাম।

তাদের মধ্যেও এ বিষয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছে বলে মনে হলো। এরপর আমি রিজিওনাল ম্যানেজার (আরএম) তারেক হাসান ভাইয়ের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলাম। রিজিওনাল ম্যানেজার ভাই বরাবরই এধরনের কাজে উৎসাহ দেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। সব শুনে তিনি আমাকে কাজ শুরু করার অনুমতি দিলেন এবং কোনো সমস্যা হলে তাকে জানানোর জন্য বললেন।

সকাল ১০টার দিকে কনা দিদি, সোহরাব, রাসেল, পরিতোষ, অমৃত, মহিউদ্দিন ও দেলোয়ারকে সঙ্গে নিয়ে কিছু লিফলেট আর হেক্সিসলের বোতল নিয়ে প্রতিদিনের মতো বের হলাম। রাস্তায় সাধারণ মানুষ, দোকানি যাদের সাথেই দেখা হলো সকলকে লিফলেট দিয়ে কীভাবে ও কেন জীবাণুমুক্ত থাকতে হবে তা  বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগলাম, সাথে হেক্সিসল দিয়ে হাত ধোয়া ফ্রি।

বাজারের এক প্রান্তে একটি কীটনাশকের দোকান থেকে ৩টি স্প্র্রে মেশিন ও জীবাণুনাশক কিনে নিলাম। তারপর স্প্রে মেশিনে পানি ভরে তাতে প্রয়োজনীয় জীবাণুনাশক মিশিয়ে শুরু করলাম আমাদের অভিযান। পথে আরও কয়েকজন সহকর্মী কামাল ভাই, জহির ভাই ও শাহিন রেজা ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের দেখা হলে তারাও আমাদের সঙ্গে সানন্দে যুক্ত হলেন। ঐদিন থেকেই আমাদের এই কর্মকাণ্ড প্রতিদিনই চলতে থাকে।

এ ব্যাপারে আমার কমিউনিটি অর্গানাইজার ভাইদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তারা যেভাবে ঝুঁকি নিয়ে উত্তপ্ত সূর্যের নিচে পিচঢালা পথে বাজারের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ছুটে অক্লান্ত পরিশ্রম করে এই কার্যক্রমকে সফল করেছেন তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। স্থানীয় প্রিন্ট ও অনলাইন পত্রিকায় এই খবর ইতিবাচকভাবে প্রচার করা হয়।

রিজিওনাল ম্যানেজার ভাইয়ের নির্দেশনায় পরদিন থেকে পুরো রিজিওনে এই কর্মসূচি শুরু করা হয়। অন্যান্য এলাকা ব্যবস্থাপকগণও আগ্রহ নিয়ে এই কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন। একে একে দেশের অনেক স্থানেই ব্র্যাকের পক্ষ থেকে যানবাহন জীবাণুমুক্ত করার কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।

এই গণপরিবহণ জীবানুমুক্তকরণ অত্র এলাকার মানুষের মধ্যে ব্যপক সাড়া ফেলে। এমনকি গণপরিবহণ থামিয়ে যাত্রীরা আমাদের বলেছেন, ‘ভাই একটু স্প্রে করে দেন’। এলাকার মানুষের চোখে ব্র্যাকের প্রতি অন্যরকম এক আস্থা দেখেছি। যখন অনেকে নিরাপদ ও সুস্থ থাকতে ঘরে আছে ঠিক সেই সময় রোগ সংক্রমণ  ঠেকাতে আমরা ব্র্যাকের কর্মীরা তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি- এটি তারা অনেক বড়ো করে দেখেছে। অনেকেই এজন্য আমাদেরকে অভিনন্দিত করেছে যা খুবই প্রেরণাদায়ক।

আমার কাজ করি মূলত আমাদের পারিবারিক চাহিদা পূরণের জন্য। কিন্তু যখন দেখি আমাদের ছোটো ছোটো কিছু উদ্যোগ আর ব্র্যাকের সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত কর্মক্ষেত্রের তথা দেশের সামগ্রিক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে তখন গর্বে বুকটা ভরে ওঠে।

 

সম্পাদনা- সুহৃদ স্বাগত, তাজনীন সুলতানা

4.4 7 votes
ব্লগটি কেমন লেগেছে?