আবেদ ভাইয়ের একাত্তর : ব্র্যাক প্রতিষ্ঠার প্রেরণাসূত্র

তারিখ: 28 এপ্রি. 2025

লেখক: আফসান চৌধুরী

আফসান চৌধুরী ২০০৬ সালে ফজলে হাসান আবেদের এই সাক্ষাৎকারটি নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধে ফজলে হাসান আবেদের ভূমিকার কথা উঠে এসেছে। মুক্তিযোদ্ধারা যে বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা ও সামাজিক অবস্থান থেকে এসে যুদ্ধে যোগ দেন, তার একটা বয়ান পাওয়া যায় এতে। একাত্তরে লন্ডনে চলে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে পশ্চিমা বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিকদের সমর্থন আদায় এবং আন্তর্জাতিক জনমত গঠন, প্রবাসী সরকার ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা এবং বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায়ে ফজলে হাসান আবেদ ও তার ভাড়াটে যোদ্ধাদের প্রচেষ্টার কথা রয়েছে। যুদ্ধের সময় মার্সেনারিদের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি সমুদ্র বন্দরে হামলার পরিকল্পনাও করেছিলেন আবেদ এবং তাঁর বন্ধুরা। এ বিষয়ে কলকাতায় বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে বৈঠকও করেন আবেদ। তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আবেদের বৈঠক থেকে বোঝা যায় যে কতটা প্রতিকূলতার মধ্য থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করছিল মুজিবনগর সরকার। একইভাবে মুক্তিযুদ্ধই যে দেশে সমাজকল্যাণ ও সমাজ উন্নয়ন ভাবনার মূল প্রেরণা তাও উঠে এসেছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে আবেদের ‘ব্র্যাক’ প্রতিষ্ঠার বর্ণনায়। ২০০৬ সালে আফসান চৌধুরীর সম্পাদনায় চার খন্ডে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থ ‘বাংলাদেশ ১৯৭১’-এর চতুর্থ খণ্ডে স্থান পায় সাক্ষাৎকারটি।

আফসান চৌধুরী : ১৯৭১ সালের মার্চের দিকে আপনি কোথায় ছিলেন?

ফজলে হাসান আবেদ : ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে আমি একটি অয়েল কোম্পানিতে চিটাগাং-এ চাকরি করতাম। ঢাকায় যখন ২৫ মার্চের হত্যাযজ্ঞ হলো তখন সেটার একটা বড় প্রতিক্রিয়া হলো আমাদের মধ্যে, যারা চাটগাঁও ছিলাম। কিন্তু চাটগাঁও তখনো স্বাধীন ছিল। বেশ কিছু দিন পর্যন্ত স্বাধীনই ছিল। তারপরই তো মুক্তিযুদ্ধের ডাক পড়ল এবং জিয়াউর রহমান চিটাগাং-এ সেটার নেতৃত্ব দিতে আরম্ভ করলেন। তিনি সেখান থেকে কালুরঘাট হয়ে ভারতে যান। আমি তখন সেখানে ছিলাম। কিছুদিন তো অফিস বন্ধই ছিল। তারপর যখন অফিস খুলতে আরম্ভ করল, আমি ভাবলাম যে, এখানে আর থাকা যাবে না। ঢাকা যাই। ঢাকা যাওয়ার পরে আমাকে অ্যাপয়েন্ট দেওয়া হলো অয়েল কোম্পানির লিয়াজোঁ অফিসার হিসেবে। আমি তখন মার্শাল ল’ হেড কোয়ার্টারে একটা রুম পেলাম।

আফসান : এই সময়ে আপনি এমন একটা জায়গায় যাওয়ার সুযোগ পেলেন, তখন ওদের মনোভাব কেমন দেখেছেন?

আবেদ : ওদের প্রতিক্রিয়া যেটা ছিল, একটা ঘৃণার ভাব। বাঙালি হিসেবে যে ট্রিটমেন্ট আমরা পেয়েছি তা সহ্য করা যায় না। সেজন্য সপ্তাহখানেক, সব মিলিয়ে আমার মনে হয় ৪/৫ দিন থেকেছি। তারপর আমি ঠিক করলাম আমি আর থাকব না। আমি বিদেশ চলে যাব। বিদেশে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল যে, সেখানে গিয়ে আমি যদি কিছু অর্গানাইজ করতে পারি। মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করতে পারি। সে জন্যই লন্ডনে যাওয়া।

আমার ছাড়পত্রে যেহেতু বাঘ মার্কা একটা আর্মি আইডেনটিটি পত্র ছিল, সেটা দেখিয়ে আমি করাচি যেতে পেরেছিলাম। করাচি গিয়ে ওখান থেকে গেলাম ইসলামাবাদে। আমাদের অয়েল কোম্পানির চেয়ারম্যান ছিলেন জেনারেল রহিম খান। উনি যখন জানলেন যে, আমি ইসলামাবাদে গিয়েছি, তখন তো উনি আইএসআইকে খবর দিলেন যে, আমি পালিয়ে যাচ্ছি, আমাকে যেন অ্যারেস্ট করা হয়।

আইএসআই সে কারণে আমাকে অ্যারেস্ট করে। আমাকে দুদিন অন্তরীণ রাখে। সে দুদিন আমাকে অনেক রকমের প্রশ্ন করা হয়। বিভিন্ন রকমের অফিসাররা বিভিন্ন আঙ্গিকে মুক্তিযুদ্ধের কথা জানতে চাইত। মুক্তিযুদ্ধ তো তখন তারা বলত না। বলত যে, বাঙালিরা কী করছে? তাদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক আছে কি না? কিন্তু কোনো সম্পর্ক না পেয়ে তারা আমাকে দুদিন পরে ছেড়ে দেয়।

ছেড়ে দেওয়ার পর আমি তখন গাড়ি করে কাবুল গেলাম। প্রথমে পেশওয়ার, তারপর বাসে করে কাবুল। কাবুলে গিয়ে বন্ধুবান্ধবকে লন্ডনে কন্টাক্ট করলাম। তারা আমাকে একটা টিকিট পাঠাল। সেটা পেয়ে দিন সাতেক কাবুলে থাকতে হয়েছিল। তারপরে গেলাম লন্ডনে।

লন্ডনে তখন আমাদের আবু সাঈদ চৌধুরী পৌঁছেছেন। তিনি বাংলাদেশের একটা লিডারশিপে ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সিলেটিদের অর্থাৎ লন্ডনে যে আমাদের প্রবাসী বাঙালি আছে, তাদের অর্গানাইজ করতে শুরু করলেন।

আমি যেটা শুরু করলাম সেটা হচ্ছে, ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’। সেটা মেইনলি ইংল্যান্ডের অধিবাসীদের নিয়ে। তাদের যাতে এটার মধ্যে সম্পৃক্ত করা যায় সে জন্য। এটার বেশিরভাগ মেম্বারই ছিল ইংলিশম্যান। যারা বাংলাদেশের অবস্থা সম্পর্কিত তথ্য নিয়ে, প্রতিবাদ হিসেবে টাইমস পত্রিকায় একটা বড় অ্যাড দিয়েছিল। এটাতে আমরা প্রায় ১০০ জন ইংলিশ বুদ্ধিজীবীর সিগনেচার নিয়েছিলাম।

আফসান : কয়েকজনের নাম কি আপনার মনে আছে?

আবেদ : অনেক অনেকজন ছিলেন। ওয়ার্ল্ড মল্ট এর ফাদার কেনেডি আমাদের স্টোন হাউজ ছিলেন। এরা অনেকে স্বাক্ষর দিলেন। এবার যিনি নোবেল পুরস্কার পেলেন সেই নাইপলও ছিলেন। যাহোক এটা বের হওয়ার পরে লোকে জানতে শুরু করল। আমরা তখন যার যার মতো করে পার্লামেন্টের মেম্বারদের সঙ্গে দেখা করতে শুরু করলাম। যাতে পার্লামেন্টের মেম্বাররা বুঝতে পারেন যে, বাংলাদেশে কী হচ্ছে! এ ছাড়া আমরা দলে দলে ভাগ হয়ে কেউ গেলাম ফ্রান্সে, কেউ গেলাম জার্মানিতে। যাতে করে ওদের সিনেট এবং পার্লামেন্টের মেম্বারদের সঙ্গে দেখা করে বলা যায়, ইস্ট পাকিস্তানে কী হচ্ছে এবং তারাও প্রতিবাদ জানাতে পারেন। এটা আমরা দলে দলে করতে আরম্ভ করলাম। এটা আসলে ছিল লন্ডনভিত্তিক একটা কাজের অংশ। ৭১-এর জুলাই, আগস্টে কতগুলো পত্রিকায় বের হতে লাগল যে, বাংলাদেশে এবার সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটবে।

কতগুলো এলাকা যেগুলো পাক আর্মির নিয়ন্ত্রণে ছিল না, যেমন রৌমারী, ভূরুঙ্গামারী এইসব এলাকা। এই এলাকাগুলোতে আর্মি খাবার যেতে দিত না। তখন আমরা ঠিক করলাম আমরা কিছু টাকা সংগ্রহ করে ওই সব এলাকায় খাবার সরবরাহ করব। সেইসঙ্গে মুক্তিবাহিনীকেও সহযোগিতা করব। তার জন্য আমরা টাকা-পয়সা তুলতে আরম্ভ করলাম।

আমরা নাম দিলাম ‘হেল্প বাংলাদেশ’। এই নামে আমরা একটা সংগঠনও গড়ে তুললাম। এর মাধ্যমে আমরা টাকা-পয়সা জোগাড় করতে শুরু করলাম। ইতিমধ্যে আমরা আরও কতগুলো জিনিস শুরু করলাম। সেটা হলো মুক্তিযুদ্ধকে সাপোর্ট করা। যুদ্ধকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য আমরা কিছু কিছু ভাড়াটে সৈন্যর সঙ্গে আলাপ করলাম। এরা ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়েও কাজ করেছে। এদের সঙ্গে আলাপ করে একটা গ্রুপের সঙ্গে প্রায় ঠিকঠাক করে ফেলেছিলাম যে, ওরা জেলেদের নৌকা নিয়ে করাচি বন্দরে গিয়ে পাকিস্তানে দু-একটা জাহাজের নিচে বোমা ফাটাবে। যুদ্ধ জাহাজগুলোকে নষ্ট করে ফেলবে। এজন্য ওরা ১৬ হাজার পাউন্ড দাবি করল। ওরা আমাদের জানাল যে, তোমরা এই টাকাটা জোগাড় করো, আমরা তোমাদের এই কাজটা করে দেব।

মুক্তিযুদ্ধের সময় লন্ডনের রাস্তায় ‘হেল্প বাংলাদেশ’-এর র‍্যালি। হাঁটছেন ফজলে হাসান আবেদ (শাড়ি পরিহিতার পেছনে)

আফসান : আপনারা কার মাধ্যমে ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন?

আবেদ : ওদের সঙ্গে যোগাযোগটা বিভিন্নরকমভাবে হয়েছিল। যার সঙ্গে ওদের দেখা হয়েছিল, সে আবার আমাকে বলল যে, ওদের সঙ্গে দেখা করো। তোমাদের কাজে লাগবে। এভাবে আমরা একজন একজন করে ওদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তারপর আমরাও প্রায় টাকা-পয়সা জুগিয়ে ফেললাম। ওরা বলল, ওদের খরচ হবে প্রায় ৭/৮ হাজার পাউন্ড, কিন্তু ওরা ডাবল মানি চায়। যাহোক, আমরা ১৬ হাজার পাউন্ড জোগাড় করে ফেললাম। আমাদের ভাবনা ছিল যে, এদের দিয়ে যদি আমরা করাচি বন্দরের একটা জাহাজও অকেজো করে দিতে পারি, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের বড় একটা বিজয় অর্জিত হবে।

এরপর আমরা ভাবলাম যে, আমরা আমাদের সরকারের কাছে জিজ্ঞাসা করে দেখি। আমাদের সরকার কী বলে। আমি আর আমার বন্ধু ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী এলাম কলকাতায়। এসে আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম। আমরা প্রধানমন্ত্রীকে বললাম যে, আমরা এই কাজটা করতে চাই। তাজউদ্দীন সাহেব একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, কাজটা করলে মন্দ হয় না। তবে কি জানেন, ১৬ হাজার পাউন্ড আমাদের খুব দরকার। এই টাকা আমাদের দিয়ে দেন। এটা দিলে আমাদের খুব কাজে লাগবে। আমরা তার কথা মেনে নিলাম। তাজউদ্দীন সাহেবের কথাই রইল। আমরা ওই কাজটা আর করলাম না। টাকাটা তাকে দিয়ে দেওয়া হলো।

এরপর জিয়াউর রহমান সাহেব একবার কলকাতা এলেন। তিনি আমাদের হোটেলে এসে দেখা করলেন। বললেন, ‘ভাই! আমরা খুব মুশকিলে আছি। আমাদের একটা দুরবিন পর্যন্ত নেই। কোথায় যে পাকিস্তানিরা আসছে, তা যে একটু দেখব তার জন্য একটা দুরবিনও নেই।’ তিনি বললেন, ‘একটা দুরবিন যদি পাঠাতে পারেন ভাই তো খুব কাজ হয়।’ লন্ডনে গিয়েই আমরা তাকে একটা দুরবিন কিনে পাঠালাম। এরপরে মেননের সঙ্গে আমাদের দেখা হলো। সে বলল, ‘শীত আসছে ভাই। আমাদের জন্য সোয়েটার পাঠান।’ ওরা তো আরেকটা বাহিনী করেছিল। মেনন বলল, ‘আমাদের জন্য আট হাজার সোয়েটার লাগবে।’ আট হাজার সোয়েটারের টাকা-পয়সা জোগাড় করা হলো। এসবই মূলত আমরা করেছি। মুক্ত এলাকায় যাতে দুর্ভিক্ষ না হয় তার জন্য আমরা টাকা-পয়সা ওঠাতে লাগলাম। ভারত সরকারকে আমরা প্রস্তাব দিলাম যে, আমরা এই এলাকাতে কতকগুলো গুদাম তৈরি করব, যাতে করে বাংলাদেশে খাবার যেতে পারে। অনুমতি দিতে দিতে তিন মাস পার হয়ে গেল। তো এর মধ্যেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে গেল।

বাংলাদেশ যেদিন স্বাধীন হয়, সেদিন আমি লন্ডনে। অনেক কিছুই শুনতে লাগলাম। একদিন শুনলাম যে, সবাই বাংলাদেশে ফেরত যাচ্ছে। আমরাও ঠিক করলাম, আমরা সবাই ফেরত আসব। সবাই বাংলাদেশে ফিরে এলাম। এসে তখন আমাকে ভাবতে হলো যে, আমি কী করব?

আবার শেল অয়েলের চাকরি ফেরত পেতে পারি। কারণ যারা চলে গিয়েছিল তারা আবার চাকরি ফেরত পাবে। অথবা বিদেশ চলে যেতে পারি। তো আমি ঠিক করলাম যে দুবছর দরিদ্র লোকদের জন্য কাজ করব। দেখলাম যে বহু শরণার্থী ভারত থেকে আসছে। এদের সমস্ত গ্রাম পুড়িয়ে বিধ্বস্ত করে দেওয়া হয়েছে। গরু-বাছুর নেই, জেলেদের জাল নেই, নৌকা নেই, সব নষ্ট।

তো আরম্ভ করলাম ‘ব্র্যাক’। শাল্লা প্রকল্প নিয়ে আমি তখন একা। প্রথমে একজন নারীকে নিলাম আমার সেক্রেটারি হিসেবে। সে হলো খুশী কবির। তারপর আরও দু-তিনশ’ নারী যোগদান করল। এভাবেই ব্র্যাকের শুরুটা হয়েছিল।

আফসান : ২৫ মার্চ-এর পর ২৬ মার্চ আপনি যখন চট্টগ্রামে ছিলেন, তখন পরিস্থিতি কেমন ছিল?

আবেদ : প্রকৃতপক্ষে তখন কোনো যুদ্ধ ছিল না। ২৬ তারিখে পাকিস্তানি আর্মি তেমন কিছু ছিল না। ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল। এবং ওরাই কর্তৃত্বে ছিলেন। চট্টগ্রাম যে আল্টিমেটলি পাকিস্তানিরা দখল করবে সেটা সম্পর্কে আমাদের কোনো সন্দেহ ছিল না। আমরা ভাবলাম যে, দিন দশেকের মধ্যে ওরা এসে দখল করার চেষ্টা করবে। হলোও তাই!

চট্টগ্রাম স্বাধীন ছিল প্রায় ৮/৯ দিন। কিন্তু সবাই ভয়ে ছিল যে, কখন পাকিস্তানি আর্মি এসে হত্যাযজ্ঞ শুরু করবে। ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম থেকে জাতির উদ্দেশে কী ঘোষণা দেওয়া যায়, সেটা নিয়ে আমরা অনেক ড্রাফ্ট করেছি। আবুল কাশেম সন্দ্বীপের ড্রাফ্ট। অনেকে বলেন যে, জিয়াউর রহমান পড়েছিলেন। কিন্তু আমাদের ড্রাফ্ট একটা ছিল। আমরাও দিয়েছিলাম।

আফসান : আপনারা কারা ছিলেন?

আবেদ : এর মধ্যে শেল অয়েল কোম্পানিতে আমরা তিনজন চাকরি করতাম। সৈয়দ হায়দার আলী, আমি ও তানভীর আহমেদ। আমরাও একটা ড্রাফ্ট তৈরি করে দিয়েছিলাম। তবে আমরা দেখেছি যে সংমিশ্রণ হয়েছে। জিয়াউর রহমান সাহেবের যে ঘোষণা শেষ পর্যন্ত গিয়েছে সেটাতে সবার পয়েন্টই একটু একটু ছিল। তো যা-ই হোক আমরা মনে করি যে এটার সঙ্গে আমরা সম্পৃক্ত ছিলাম। এটা একটা আহ্বান ছিল যে, বাঙালি জাগো।

আফসান : বাঙালি-অবাঙালিদের মধ্যে তখন কি কোনো ধরনের গন্ডগোলের কথাবার্তা শুনছিলেন?

আবেদ : বাঙালি-অবাঙালিদের মধ্যে গন্ডগোলের কোনো খবর চট্টগ্রামে হয়নি। পরে যখন আর্মি দখল শুরু করল তখন বাঙালি হত্যাযজ্ঞ আরম্ভ হলো। সেটা এপ্রিলের ৮/১০ তারিখ হবে।

আফসান : আপনার ঢাকায় আসাটা সম্ভবপর হলো কী করে?

আবেদ : আমি তখন শেল অয়েল কোম্পানিতে চাকরি করতাম। তখন কতগুলো স্টল প্লেন শর্ট ডিসটেন্সে নামতে পারত। শর্ট টেক অফ ল্যান্ডিং স্টল প্লেন ২/৩টা ছিল। সেগুলোতে মাঝে মাঝে টিকিট পাওয়া যেত। আমি যেহেতু শেল অয়েল-এ চাকরি করতাম, সে কারণে প্রায়ই ঢাকা আসতাম। সবাই আমাকে চিনত। কাজেই পাকিস্তান এয়ারলাইনসে যারা ছিল তাদের কাছ থেকে একটা টিকিট আমি জোগাড় করতে পেরেছিলাম। ঢাকায় এলে ওরা আমাকে বলল যে, তুমি যখন ঢাকায় এসেছ, তখন তুমি ঢাকা অফিসে দায়িত্ব পালন করো।

আফসান : আপনি যখন সেনাবাহিনীর সঙ্গে ছিলেন তখন কি কোনো দুশ্চিন্তা বা ভয়ের মুহূর্ত ছিল?

আবেদ : আমি তো চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর অনেক হত্যাযজ্ঞ দেখেছি। কাজেই বাঙালিদের প্রতি তাদের ঘৃণা খুব পরিষ্কার ছিল। আবার ঢাকাতে যেখানে বসতাম, সেখানে আমার পাশের রুমে একজন কর্নেল বসতেন। আমার মনে হতো যে, উনার কাছে আমি একটা মানুষই না। এমন একটা ভাব। সে রকমই পজিশন ছিল আমাদের।

আফসান : পাকিস্তানে গিয়ে কি আপনার মনে হয়েছে যে আমাদের দেশে কী হচ্ছে তারা তা জানে?

আবেদ: নাহ্। বরং পাকিস্তানে গিয়ে আমি আশ্চর্য হয়েছি। পাকিস্তানের মানুষ কিছুই জানে না। ওরা উল্টো বলে যে, বাঙালিরা এই রকম করল কেন? আমাদের আর্মি মারছে কেন? বাঙালিরা আমাদের বিপক্ষে চলে যাচ্ছে কেন? ওরা ২৫ মার্চের ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানত না। এ ছাড়া অনেক পাকিস্তানি বন্ধুদের যাদের সঙ্গে একত্রে কাজ করতে হয়েছে, তারাও বলত যে, আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছি না, বাঙালিরা এতটা বদলে গেল কেন?

আফসান : কলকাতায় গিয়ে যখন আপনি তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে দেখা করলেন তখন তার ব্যক্তিত্বটা কেমন মনে হয়েছিল? তিনি কি ভেঙে পড়েছেন?

আবেদ : তাজউদ্দীন সাহেব ছিলেন সৌম্য শান্ত এক ভদ্রলোক। আমি যখন তার কাছে গেলাম আমার মনে আছে, তখন বিকেল ৬টার মতো হবে। উনি একটা লুঙ্গি পরে চেয়ারে বসে ছিলেন। তিনি আমাদের কথা শুনলেন। তারপর বললেন, ‘দেখেন, আমাদের দেশের অনেক সমস্যা। কবে যে আমাদের দেশ স্বাধীন হবে তা আমরা জানি না। কিন্তু আমাদের টাকা-পয়সা দরকার। আপনারা যারা বিদেশ থেকে যে সামান্যটুকু পাঠাচ্ছেন, সেটা আমাদের স্বাধীনতাকে জোরদার করছে। যদি কোনো টাকা না পাই, তাহলে আমরা পুরোপুরি পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ব। কাজেই টাকাটা আমাদের খুব দরকার।

আফসান : যেদিন বাংলাদেশ স্বাধীন হলো সেদিন বিলেতের অবস্থাটা যদি একটু বর্ণনা করেন।

আবেদ : ১৬ ডিসেম্বরের আগে যখন ৫ কি ৬ ডিসেম্বর, আমার মনে আছে, তখন আমি ডেনমার্ক ছিলাম, সেদিন ইন্ডিয়া বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল। ডেনমার্কে আমি আর আমার এক বন্ধু গেছি আমরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের ব্যাপারে ডেনমার্কের ফরেন মিনিস্টারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম।

বাংলাদেশের জন্য তখন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জরুরি দরকার ছিল। তো ওরা সেদিন বলল যে, ‘ইন্ডিয়া হ্যাজ নাউ রিকগনাইজড, উই ক্যান নট রিকগনাইজ ইউ দিস মোমেন্ট। বাট অ্যাজ সুন অ্যাজ উই ক্যান, উই উইল ডু ইট।’ ডেনমার্কে তখন ফরেন মিনিস্টার যিনি ছিলেন হি ওয়াজ ভেরি ওয়ার্ম টুয়ার্ডস আস। যতটুকু মনে আছে, ১৭ বা ১৮ ডিসেম্বর ইউরোপিয়ান দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশকে প্রথম সমর্থন দিয়েছিল ডেনমার্ক।

আফসান : আপনি ১৬ই ডিসেম্বর তাহলে ডেনমার্কে ছিলেন?

আবেদ : নাহ্। ১৬ তারিখে লন্ডনে চলে এসেছি। বিবিসির রিপোর্ট দেখছি। তখন আমাদের অনুভূতি অন্য রকম হয়েছিল। ১৬ তারিখের বিজয়টা আমার কাছে তেমন একটা বড় বিজয় মনে হয়নি।

তখন হঠাৎ করে মনে পড়ল যে, আমাদের অনেক বন্ধু-বান্ধব মারা গেছে। এই যে ইউনিভার্সিটির লোকজন, ওই যে হত্যাকান্ড বিজয় দিবসের আগে হলো, শহীদুল্লা কায়সার নেই, ড. চৌধুরী নেই। এদের তখন মিস করছিলাম।

শহীদুল্লা কায়সারের সঙ্গে আমার দেখা হয়, আমার পাকিস্তান যাওয়ার আগের দিন। তিতাস গ্যাস কোম্পানির ডিরেক্টরের সঙ্গে আলাপ করব বলে বসে আছি। দেখি শহীদুল্লা কায়সারও বসে আছেন। আমি বললাম, শহীদ ভাই, এখানে কী করছেন?

তিনি বললেন, কী করব? তোমরা এখানে বসে আছ কেন?

তো এই কথা মনে করে তখন খুব খারাপ লাগল। মনে হলো এতগুলো লোকের বিনিময়ে আমরা এটা পেলাম। বিজয়-অবিজয়ে ভালো লাগা এটুকুই। কিন্তু উই অলসো লস্ট সাম আফ বেস্ট পিপল!

5 1 vote
ব্লগটি কেমন লেগেছে?