আঞ্চলিক ভাষায়শিক্ষা ও বিনোদন

তারিখ: 12 ফেব. 2024

লেখক: সাব্বির আহমেদ ইমন

“বন্ধুরা, পিংকী আছি আপনারার লগে। আপনারা ভালা আছইন নি? আইজ আপনারার লগে মাতমু আর আপনারারে হুনাইমু পছন্দর গান। ০১৭৮০২০১৩১৩ এই নাম্বারে জানাই দেইন আপনার পছন্দর গানর কথা। আপনারা অনুরোধ করতে থাকুইন। চলইন আমি আপনারারে হুনাইয়া আই আমার পছন্দর গানটা।”

রেডিও পল্লীকণ্ঠের স্টুডিওতে এই কথাগুলো বলছিলেন পিংকী আপা। তিনি অনুরোধের গানের আসর কখনো বসন্ত কখনো শ্রাবণ-এর সঞ্চালক। সামনে রাখা মাইক্রোফোনে পিংকী আপা কথা বলছিলেন নানা বিষয় নিয়ে, পড়ছিলেন শ্রোতাদের পাঠানো এসএমএস, আবার গানের ফাঁকে ফাঁকে শ্রোতাদের জিজ্ঞাসার উত্তরও দিচ্ছিলেন। অনুরোধের গানের আসর মানে তো শ্রোতার পছন্দের গান শোনানোর পাশাপাশি তার অনুভূতিকেও সম্মান জানানো। এখানেই পিংকী আপা অনন্য। অচেনা শ্রোতাদের একই সূত্রে গেঁথে নিয়েছেন অনায়াসে। সামনে কোনো স্ক্রিপ্ট রাখা নেই, কাউকে চেনা নেই অথচ কী স্বতঃস্ফূর্ততা!

রেডিও পল্লীকণ্ঠের ১২ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে তাদের অফিসে গিয়েছিলাম কার্যক্রম দেখতে। প্রথমেই দেখলাম ছোট্ট একটা রুমে বসেই পিংকী আপার অগণিত শ্রোতার হৃদয় জয় করা অনুষ্ঠান।

প্যানেলে বসে অনুষ্ঠান সম্পাদনা করছেন রোজিনা

২০১২ সালে শুরু হয় রেডিও পল্লীকণ্ঠের কার্যক্রম। এটি বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় একটি কমিউনিটি রেডিও। দিনে ১২ ঘণ্টা সম্প্রচারিত হচ্ছে। বর্তমানে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেট জেলার মোট ১১টি উপজেলার ১০ লাখ মানুষ এর সম্প্রচার শুনতে পাচ্ছে।

ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন ও আইনি সুরক্ষা কর্মসূচি (সেলপ)-এর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত রেডিও পল্লীকণ্ঠের বিশেষত্ব হলো, এটি বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান সম্প্রচারের পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। রেডিওর অনুষ্ঠান প্রচারিত হচ্ছে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায়। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আঞ্চলিক ভাষা রক্ষায় এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।

মণিপুরী, খাসিয়া, উরাং, মুন্ডাসহ অন্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের ভাষাতেও প্রচারিত হয় বিভিন্ন অনুষ্ঠান। কারণ সম্প্রচার এলাকার বাসিন্দা তারাও। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মাঝে তাই রেডিও পল্লীকণ্ঠের অনুষ্ঠানগুলোর বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আধিপত্যের এ যুগেও কমিউনিটি রেডিওর এমন জনপ্রিয়তা সত্যিই মুগ্ধকর।

চা শ্রমিক নারীর সাক্ষাতকার গ্রহণ করছেন সোহেনা বেগম

রেডিওর অনুষ্ঠান তৈরির সময় সাধারণত তথ্য, শিক্ষা, বিনোদন ও উন্নয়নে উদ্বুদ্ধকরণ এ বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্রায় ৩৬টি বিষয় নিয়ে প্রতি মাসে বিভিন্ন অনুষ্ঠান সাজায় তারা। এখন কথা বলব রেডিও পল্লীকণ্ঠে প্রচারিত অনুষ্ঠানমালা নিয়ে।

ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান গৌরবের মৌলভীবাজার-এ উঠে আসে সিলেট বিভাগের নানা দর্শনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বর্ণনা। উপস্থাপক দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের সঙ্গেও কথা বলেন, জানতে চান তাদের অনুভূতি এবং কীভাবে এসব স্থানকে আরও পর্যটকবান্ধব করে গড়ে তোলা যায়।

কৃষকদের জন্য নিয়মিত আয়োজন সোনাফলা মাটি। রেডিও পল্লীকণ্ঠের প্রতিনিধিরা মাঠে গিয়ে কৃষক ভাইদের কাছে জানতে চান ফসলাদির খবরাখবর। চাষাবাদ বিষয়ে কারও কোনো জিজ্ঞাসা থাকলে একজন কৃষি অফিসারের পরামর্শ নেওয়া হয়। এভাবে আলোচনা থেকেই উঠে আসে সমস্যার সঠিক সমাধান। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করা হয় তা হলো আবহাওয়া বার্তা। হাওরাঞ্চলের কৃষকদের জন্য এই অনুষ্ঠানেই প্রচারিত হয় আগাম বন্যার সতর্ক বার্তা। এতে আকস্মিক বন্যা শুরুর আগেই তারা তাদের ঘাম ঝরানো ফসল ঘরে তুলে নিতে পারেন। এছাড়াও এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পতিত জমি বা বাড়ির আঙিনায় সবজি চাষের জন্য নারীদের উদ্বুদ্ধ করা হয়।

মাঠে কৃষকের সঙ্গে কথা বলছেন রেডিও পল্লীকণ্ঠের প্রতিনিধি রিমন

মিষ্টি ময়না সরাসরি সম্প্রচারিত হয় স্টুডিও থেকে। এখানে ব্র্যাকের আপন তারা প্রতিযোগিতায় সংগীত বিভাগে বিজয়ী আঁখি পালিত ক্ষুদে ভক্তদের গান শেখান। আর চল খেলতে খেলতে শিখি হলো শিশুদের জন্য ইংরেজি ভাষা শিক্ষার ক্লাস।

স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের জন্য আছে রঙিন ক্যাম্পাস। বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় রেডিওতে তারা সরাসরি কথা বলে। বাল্যবিয়ে, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ এবং ৯৯৯ এর মতো বিভিন্ন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ হটলাইন নম্বরগুলো শিক্ষার্থীরা এই অনুষ্ঠান থেকেই জেনে নেয়। এছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজনও থাকে।

স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠান রঙিন ক্যাম্পাস

“বাঙালির খানির তালিকার মাঝে পয়লা খানি অইছে মাছ-ভাত। আমরা বাঙালি হকলে মসলাযুক্ত খানি অকল (ভর্তা) বেশি ভালা পাই। আমি রুজিনা সবরে শুভেচ্ছা জানাইয়া আরম্ভ কররাম রান্দা বিষয়ক রেডিও অনুষ্ঠান আমারার উন্দাল।”

আমরার উন্দাল মানে রান্নার নানা রেসিপি নিয়ে সাজানো অনুষ্ঠান। সরাসরি রান্নাঘরে গিয়ে হাজির হয় রেডিও পল্লীকণ্ঠ। সেখান থেকে শ্রোতারা শুনে শুনে শিখে নেন সুস্বাদু খাবারের নানা রেসিপি।

নারীকণ্ঠ-তে নারী শিক্ষার গুরুত্ব, সমাজে নারীর অধিকার কীভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায় এবং নারী উদ্যোক্তাদের অনুপ্রেরণামূলক গল্পগুলো থাকে। বয়ঃসন্ধিকালের বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন সম্পর্কে কিশোর-কিশোরীদের জানাতে প্রচারিত হয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান সোনালি কৈশোর। চা শ্রমিকদের শিক্ষা ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে আছে অনুষ্ঠান জীবনধারা। এছাড়াও প্রচারিত হয় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ, রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল গীতি, ভাটি গান, ছায়াছবির গান নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন অনুষ্ঠান।

নিয়মিত অনুষ্ঠানের পাশাপাশি সরকারি জনহিতকর গুরুত্বপূর্ণ বার্তাগুলোও জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দেয় রেডিও পল্লীকণ্ঠ। কোভিড-১৯ মহামারির সময় জানিয়েছে মাস্ক ব্যবহার ও হাত ধোয়ার সঠিক নিয়ম। পাশাপাশি কোয়ারেন্টাইনের ব্যাপারেও সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সেসময় ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচির শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান রেডিও স্কুল প্রচারিত হয়েছিল। প্রি-প্রাইমারি পর্যায়ের প্রায় ৪৭ হাজার শিক্ষার্থী এতে যুক্ত হয়েছিল।

দীর্ঘ এক যুগের পথচলায় রেডিও পল্লীকণ্ঠের ঝুলিতে যোগ হয়েছে ২৪টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার। এর মধ্যে জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড, ইউনিসেফ মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড, বাংলাদেশ কমিউনিটি রেডিও অ্যাসোসিয়েশন অ্যাওয়ার্ড, এশিয়া প্যাসিফিক ব্রডকাস্টিং ইউনিয়ন অ্যাওয়ার্ড উল্লেখযোগ্য।

রেডিও পল্লীকণ্ঠের অর্জিত বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা স্মারক

রেডিও পল্লীকণ্ঠের রয়েছে ২০টি শ্রোতাক্লাব। তারা নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে পুনর্মিলনীর আয়োজন করে থাকে। তাছাড়া তাদের কাছ থেকেও আসে নানা অনুষ্ঠান পরিকল্পনা ও সম্প্রচারেরর দারুণ সব আইডিয়া।

সবশেষে রেডিও পল্লীকণ্ঠের কর্মীদের কথা না বললেই নয়। নিয়মিত কর্মীদের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবেও এখানে অনেকে কাজ করছেন। স্বেচ্ছাসেবক কর্মীদের কেউ কেউ এখনও পড়ালেখা করছেন, কেউ আবার ঘরসংসার সামলিয়েও আছেন রেডিও পল্লীকণ্ঠের সঙ্গে। এখানে প্রত্যেকে যে যেই অনুষ্ঠান পরিচালনা করছেন, তিনি নিজেই পরিকল্পনা, স্ক্রিপ্ট লেখা থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ আয়োজনের দায়িত্বে থাকেন।

রেডিও পল্লীকণ্ঠের অফিস থেকে সেদিন খুব ভালোলাগা নিয়ে ফিরেছিলাম। কমিউনিটি রেডিও সাধারণ মানুষের রেডিও, তাদের বিনোদন ও শিক্ষার একটি শক্তিশালী মাধ্যম।  তাদের কার্যক্রম দেখতে গিয়ে মনে হলো, কর্মীদের কাছে এটি শুধু একটি চাকরি নয়, এর চাইতেও বেশি কিছু!

রেডিও পল্লীকণ্ঠ টিম

4.5 2 votes
ব্লগটি কেমন লেগেছে?