Skip to main content
Last modified on Monday, 26 April 2021 19:06

অ্যালানশন ফেইনস্টেইন ওয়ার্ল্ড হাঙ্গার পুরস্কার গ্রহণকালে স্যার ফজলে হাসান আবেদের ভাষণ

Rate this item
(1 Vote)

"প্রেসিডেন্ট ভারটান গ্রেগরিয়ান, মি. এলি উইসেল, মি. মোরলে সেফার, মি. অ্যালানশন ফেইনস্টেইন, মি. রবার্ট ক্যাটস, পুরস্কার প্রাপ্তগণ ও ভদ্রমহোদয়গণ,
আজকের সন্ধ্যায় এখানে উপস্থিত হতে পেরে আমি খুব উৎফুল্ল বোধ করছি। আমরা খুব আনন্দ সহকারে অ্যালানশন ফেইনস্টেইন ওয়ার্ল্ড হাঙ্গার পুরস্কার গ্রহণ করছি। ব্র্যাক এবং যে জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আমরা কাজ করি, তাদের পক্ষ থেকে আমি এই পুরস্কারের জন্য ব্রাউন কর্পোরেশনের বোর্ড অব ফেলোস এর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। এই স্বীকৃতি আমাদের অসমাপ্ত কাজ সম্পাদনে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
 
ভদ্রমহিলা ও মহোদয়গণ,
পৃথিবীর যে অংশ থেকে আমি এসেছি, সে অংশে ক্ষুধা মানুষের নিত্যসঙ্গী, দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতা সর্বব্যাপী এবং রোগ-মৃত্যু অসংখ্য। যেখানে বঞ্চনা নিয়ম, ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচাইতে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর একটি। বাংলাদেশের আয়তন নিকারাগুয়া বা যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের সমান কিন্তু এর জনসংখ্যা ১১ কোটি। পৃথিবীর অন্যকোনো দেশ এতটা ঘনবসতিপূর্ণ নয়। দেশের জনসাধারণ দরিদ্র। ষাট শতাংশ পরিবারের জমি নেই। এমনকি ২০ শতাংশ পরিবারের নেই বসতভিটা। জনগণের মাথাপিছু বার্ষিক আয় ১৬০ মার্কিন ডলার, ৮০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে এবং ৬০ শতাংশ মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে দাড়িয়েছে এবং যখন আমরা আরেকটি নতুন দুর্যোগের মুখোমুখি হব, তখন আপনারা আরও দুর্ভোগের কাহিনী শুনতে পাবেন। স্বাস্থ্য পরিস্থিতিও ভালো নয়। শিশুমৃত্যুহার প্রতি হাজারে ১২০ জন, যা আপনাদের দেশের তুলনায় ১০ গুণ বেশি। ৫০ শতাংশ শিশু কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। প্রসূতি মৃত্যুহার নরওয়ের তুলনায় ৩শ গুণ বেশি। মাত্র ১৫ শতাংশ মহিলা ও ২৫ শতাংশ পুরুষ লিখতে ও পড়তে সক্ষম। এসবই কঠোর পরিসংখ্যান। একবিংশ শতাব্দীতে পদার্পণ করতে আর মাত্র দশ বছর বাকি এবং এটা আমাদের সকলের জন্য লজ্জার বিষয় যে, এরকম পরিস্থিতিকে আমরা এখনও চলতে দিচ্ছি। কিন্তু এরকম অবস্থা বেশিদিন চলতে দেওয়া যাবে না।
 
ভদ্রমহিলা ও মহোদয়গণ,
চলুন, আমরা ক্ষণিকের জন্য ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাই। যে সমাজে আমরা বাস করছি সে সমাজ কতিপয় কালো অধ্যায় পেরিয়ে এসেছে, যা আমাদের সভ্যতাকে কলঙ্কিত করেছে। মানুষ ওই যুগে নানা সামাজিক ব্যাধি ও কুসংস্কার, নিষ্ঠুরতা ও অভিশাপ, প্রগতিবিরোধী রীতি ও মূল্যবোধ প্রভৃতির শিকার ছিল। অবশ্য পরে তা পরিত্যক্ত হয়েছে। মহান নেতৃবৃন্দ এবং লাখো লাখো সাহসী মানুষ অসীম ধৈর্য্যসহকারে মন্দের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন এবং একটি ন্যায় এবং সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। কয়েকটি উদাহরণ দিই—দাসপ্রথা সারাবিশ্বে এখন অভিশাপ বলেই বিবেচিত হয় অথচ ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে এটি গ্রহণযোগ্য ছিল। ১৮৩৩ সালে দাসমুক্তির আইন পাশের মাধ্যমে আপনারা ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। এ কাজে কোয়াকার্স (জর্জ ফক্স কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সংগঠন)-এর অনেক বড় অবদান রয়েছে। উপনিবেশবাদের অবস্থাও তাই। সাবেক উপনিবেশগুলোতে মহাত্মা গান্ধীর মতো ব্যক্তিদের নেতৃত্বে উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনের ফলে এ শতাব্দীর মধ্যভাগে উপনিবেশবাদ ঘৃণ্য ও অচল হয়ে যায়। আপনাদের সাহসী স্বাধীনতাপ্রিয় পূর্বপুরুষেরা এক্ষেত্রে অনেকটা অগ্রসৈনিকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। একইভাবে যদিও জাতিভেদ ও বর্ণপ্রথা এখনও বিলুপ্ত হয়নি, তথাপি এটি মানব সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় এবং আশা করা যায় সহসা তা বিলুপ্ত হবে। মার্টিন লুথার কিংসহ লক্ষ লক্ষ মানুষের আত্মদানকে আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি, যারা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়েছেন। কিন্তু ভদ্রমহিলা ও মহোদয়গণ, ক্ষুধা, রোগ বা নিরক্ষরতা যা আমাদের সমাজকে এখনও অচল করে রেখেছে ও লাখ লাখ মানুষকে শৃঙ্খলিত করে রেখেছে, সে ব্যাপারে কী করা হয়েছে? এ লজ্জা আমাদের সকলের। মানবজাতি এবং আমাদের সভ্যতার জন্য এটি অভিশাপ। কোনো প্রতিবিধান ছাড়া এটি চলতে থাকবে তা কিন্তু হতে পারে না।
 
ভদ্রমহিলা ও মহোদয়গণ,
এখন আমাদের ঘোষণা করার সময় এসে গেছে যে, দাসপ্রথা, উপনিবেশবাদ এবং বর্ণপ্রথার মতো দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতাও গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের অবশ্যই মানবিক মূল্যবোধ, প্রজ্ঞা ও বিবেককে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্মুক্ত করে দিয়েছে বিশাল জ্ঞানভাণ্ডার এবং সুযোগ যা তা এই গ্রহের প্রতিটি মানুষের জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারে। আমাদের অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে যাতে এই পৃথিবীর সকল মানুষ বিজ্ঞান ও সভ্যতার ফল সমভাবে ভোগ করতে পারে এবং রোগ, অন্ধকার ও নিদারুণ দারিদ্র্যের মাঝে ধুঁকে ধুঁকে না মরে। ব্র্যাকে আমরা সে লক্ষ্যেই কাজ করছি, আমরা আমাদের জনগোষ্ঠীর বিশেষ করে সমাজের দরিদ্র ও অবহেলিত জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির চেষ্টা করছি।

এক মানবিক প্রয়োজনের তাগিদ থেকে ১৯৭২ সালে ব্র্যাকের জন্ম হয়। সহসা আমরা বুঝতে পারলাম, যে পল্লিবাসীদের সঙ্গে আমরা কাজ করছি–তাদের শুধু রিলিফ নয়, আরও কিছু প্রয়োজন। তাদের প্রয়োজন শিক্ষা, নিরাময় ও প্রতিরোধযোগ্য স্বাস্থ্যসেবা, ঐকমত্য এবং ঋণ। ব্যবহারিক শিক্ষা এবং পেশাগত দক্ষতার জন্য প্রশিক্ষণ ও সহজ শর্তে ঋণ প্রদান প্রভৃতির মাধ্যমে ভূমিহীন ও সমাজের সুবিধাবঞ্চিত অন্য মানুষ যেমন মহিলাদের সমবায়ের ভিত্তিতে আমরা সংগঠিত করেছি। ইতিমধ্যে এভাবে আমরা পাঁচ লাখ নরনারীকে সমবায়ের মাধ্যমে সংগঠিত করছি এবং পনের মিলিয়ন ডলার বন্ধকহীন ঋণ সহজ শর্তে প্রদান করেছি। এই সেবা সমাজে তাদের মর্যাদা দিয়েছে এবং আয় ও কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ সৃষ্টি করছে। আমরা এই প্রচেষ্টার সম্প্রসারণ ঘটাচ্ছি এবং এই শতাব্দীর শেষে বাংলাদেশের এক-পঞ্চমাংশ গ্রাম কর্মসূচির আওতায় আসবে।

আমাদের দেশে ৭০ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ ছেলেমেয়ে লেখাপড়া শেখার আগেই স্কুল ত্যাগ করে। সর্বাধিক দরিদ্র শ্রেণির যেসব ছেলেমেয়ে এভাবে স্কুল ত্যাগ করে বা কখনও স্কুলে আসে না, তাদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য আমরা উপআনুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচি চালু করেছি। এ কর্মসূচির প্রাথমিক সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে আমরা ৩ হাজার ৫শ টি স্কুল খুলেছি এবং এসব স্কুলের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী মেয়েশিশু।

যেহেতু ডায়রিয়া আমাদের সমাজে উচ্চ মৃত্যুহার ও মরণাপন্ন অবস্থার জন্য দায়ী, সেহেতু প্রতিটি ঘরে আমরা আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীদের পাঠিয়েছি, তারা সেখানে প্রত্যেক মা-কে লবণ, গুড় ও পানি দিয়ে ঘরে বসে ডায়রিয়া চিকিৎসার স্যালাইন তৈরি শিখিয়েছে। বাংলাদেশের ১ কোটি ৩০ লাখ বাড়িতে এই স্বাস্থ্যশিক্ষা প্রদান করা হয়েছে।
কিন্তু এগুলো যথেষ্ট নয়। ভদ্রমহিলা ও মহোদয়গণ, আমাদের আরও অনেক কিছু করার বাকি আছে। আমরা এই শতাব্দীর শেষ দশকে রয়েছি কিন্তু এখনও দারিদ্র্য, অজ্ঞতা ও রোগ প্রতিকারহীন অবস্থায় চলছে। এ সকল ঘটনা পৃথিবীর এ অংশে ব্যতিক্রম নয়, এখনও নিয়ম হয়েই আছে। আমরা অবশ্যই এগুলো দূর করব, যাতে এগুলো নিয়ম না হয়ে ব্যতিক্রম হয়ে থাকে। এর প্রতিবিধানে আপনাদের সহায়তা, সমর্থন ও সহানুভূতি প্রয়োজন। আমি নিশ্চিত আপনারা আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, এ কাজে শিল্পোন্নত ধনী দেশগুলোতে জনমত গঠনের প্রয়োজন রয়েছে।

ব্র্যাককে এ বছরের অ্যালানশন ফেইনস্টেইন ওয়ার্ল্ড হাঙ্গার পুরস্কার প্রদান করে সম্মানিত করায় আমি পুনরায় ব্রাউন ইউনিভার্সিটিকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমরা খুবই কৃতজ্ঞ।

ধন্যবাদ।"

স্যার ফজলে হাসান আবেদ
সন: ১৯৯০

Read 3425 times Last modified on Monday, 26 April 2021 19:06

Join the world’s biggest family

sign-up

Subscribe

STAY INFORMED. Subscribe to our newsletter.

Top