Banner

১৯৭০

১১ই নভেম্বরের গভীর রাত। নেমে এলো ভয়াবহ বিপর্যয়, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর উপকূলীয় দ্বীপগুলোতে যেন নেমে এলো খণ্ডপ্রলয়।

একরাতের ব্যবধানে এত ধ্বংস, এত মৃত্যু এর আগে আর কখনও কেউ দেখেনি। বাংলাদেশ তখন পাকিস্তানের অংশ।

পরের দিন বিপন্ন মানবতার পাশে দাঁড়াতে আরও অসংখ্য মানুষের মতো ছুটে গিয়েছিলেন একজন ফজলে হাসান আবেদ, শেল কোম্পানির হেড অফ ফাইন্যান্স- দেশবিখ্যাত কেউ নন। সেদিনের সেই পদক্ষেপ ছিল একটি বৃহত্তর অভিযাত্রার প্রথম ধাপ। প্রকৃতপক্ষে বিশ্বের সর্ববৃহৎ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের সেদিনই যাত্রা শুরু হয়েছিল।

১৯৭১

সততা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে আবেদ ভাই দেশের মানুষের জন্য যুদ্ধে নামলেন। তহবিল সংগ্রহে, প্রতিষ্ঠিত চাকরি ছেড়ে তিনি পাড়ি দিলেন দুর্গম পথ। মানুষের স্বাধীনতার জন্য লড়াকু মানসিকতা এবং ভালোবাসাকে পুঁজি করে।

জানুয়ারি

১৯৭২

স্বাধীন বাংলাদেশে পা রাখলেন আবেদ ভাই। যুদ্ধবিধ্বস্ত নিজের দেশকে নতুন করে গড়ার প্রত্যয়ে, মানুষের মঙ্গলের কামনায়।

ফেব্রুয়ারি

১৯৭২

'ব্র্যাক' নাম নিয়ে পুরোদমে উন্নয়নের কাজ শুরু করলেন আবেদ ভাই।

ফেব্রুয়ারি

১৯৭২

দিরাই ব্র্যাক অফিসে প্রথমবার এলেন আবেদ ভাই। মুক্ত দেশে আর্থিকভাবে বন্দি সেখানকার মানুষ, আবেদ ভাই তাদের পাশে দাঁড়াতে চাইলেন।

১৯৭৪

কুড়িগ্রামের রৌমারিতে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসে ব্র্যাক। ক্ষুধার্ত জনপদে কাজ করতে গিয়ে আবেদ ভাই নারীর অবস্থান সম্পর্কে প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত সত্য আবিষ্কার করেন। এখানে ব্র্যাক মাত্র ৪ মাস জরুরি ত্রাণ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে, যা কাজে লেগেছে ৪০ বছর পরে এসেও।

সেবছরই মাইক্রোফাইন্যান্স কর্মসূচি শুরু করে ব্র্যাক।

১৯৭৫

উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের শুরু থেকেই আবেদ ভাই নারী শক্তির গুরুত্ব ও অপরিহার্যতাকে উপলব্ধি করেছিলেন। সেই উপলব্ধিতে প্রতিফলিত হয় সার্বজনীনতা, যা আজ ব্র্যাকে একটি মূল্যবোধ হিসেবে চর্চা করা হয়।

এই চিন্তা থেকে জামালপুর মহিলা প্রজেক্ট শুরু করে ব্র্যাক। গ্রামের দরিদ্র নারীদের শিক্ষা, সামাজিক সচেতনতা, পরিবার পরিকল্পনা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, হাঁস-মুরগি পালনসহ যৌথ সঞ্চয় এবং সমবায়ভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের আওতায় আনা হলো।

১৯৭৬

বিগত বছরগুলোতে নানা ধরনের সিদ্ধান্ত এবং পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে আবেদ ভাই বিস্তর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। সেইসব অভিজ্ঞতা থেকে তিনি এবার মানিকগঞ্জে শুরু করলেন সমন্বিত প্রকল্প।

কৃষি, হর্টিকালচার, গবাদি পশুপালন, রিকশা ও ভ্যান চালানো, ছোটো ব্যবসায় এসব কাজের সুযোগ থাকায় মানুষকে একক ঋণ দিতে শুরু করে ব্র্যাক। আবেদ ভাইয়ের লক্ষ্য ছিল মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা, এই লক্ষ্যে তিনি কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু করলেন। আমরা পেলাম কার্যকারিতার দৃষ্টান্ত।

১৯৭৭

কার্যকারিতার এই ধারাবাহিকতায় শুরু হলো দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষ- দিনমজুর, মৎস্যজীবী, কুমার ও তাঁতিদের নিয়ে দল গঠন করে গ্রাম সংগঠন গড়ে তোলা। এই সংগঠনে নিয়মিত সাপ্তাহিক সভা আয়োজনের মাধ্যমে সামাজিক সমস্যা সমাধান, অর্থনৈতিক, দক্ষতা অর্জন, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করা হতো এবং বিভিন্ন কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করা হতো।

১৯৭৭

পরবর্তী

শুরু হয়ে গেছে বৃহৎ কর্মযজ্ঞ। এই কর্মযজ্ঞ পরিচালনায় আসছে চ্যালেঞ্জ, দেখা দিচ্ছে প্রতিকূল পরিস্থিতি।

মানিকগঞ্জে মুরগিপালনের শুরুর দিকে ব্র্যাক উপলব্ধি করল মুরগি বাঁচিয়ে রাখতে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে, যেহেতু অনেক হাঁস-মুরগি ক্রমাগত মারা যাচ্ছিল। ব্র্যাক এগিয়ে এলো সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী মনোভাব নিয়ে। শুরু হলো ভ্যাকসিনেশন, সেই ভ্যাকসিন নিরাপদে আনা নেওয়া করতে ইনস্যুলেটর হিসেবে পাকা কলার ব্যবহার করা হতো।

১৯৭৮

শুরু হলো আড়ং-এর যাত্রা। লোকশিল্পের শিল্পমূল্য এবং এর বাণিজ্যিক সম্ভাবনাকে ভিন্ন মাত্রা এতে দিতে শুরু হয় এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। আয়েশা আবেদ নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন দরিদ্র কারুশিল্পীদের জীবনমান বদলে দেবার এক বিশাল দায়িত্ব।

উদ্ভাবন, সৃজনশীলতা এবং কার্যকারিতার এক অপূর্ব সমন্বয়ে শুরু হলো রেশমচাষ। সার্বজনীনতার উদ্দেশ্যে তুঁতচাষসহ নার্সারি পরিচালনায় উৎসাহ দিতে থাকল ব্র্যাক।

আড়ং-এর একনিষ্ঠতায় নতুন করে প্রাণ পেল এদেশের গর্ব জামদানি শাড়ি। এই সাংস্কৃতিক অভিযানে ফিরে এসেছে অতীতের গৌরবময় ঐতিহ্য, তৈরি হয়েছে কর্মসংস্থান।

১৯৮০
-
১৯৯০

Oral Therapy Extension Programme- শুরু হলো ওটেপ, শুরু হলো খাবার স্যালাইন তৈরির শিক্ষা দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া। সারা বাংলাদেশে প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে লবণ-গুড়ের স্যালাইন বানানো শেখাতে সময় লেগেছিল ১০ বছর।

১৯৮৫

ব্র্যাকের উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে এলো আলো জ্বালানোর অঙ্গীকার। একজন শিক্ষিকা টানা ৩ ঘণ্টা করে ছেলেমেয়েদের বাংলা, অংক, ইংরেজি সবই পড়াচ্ছেন- পাশাপাশি নাচ-গান, ছবি আঁকা, ছড়া, আবৃত্তি, নাটক সবকিছু মিলিয়ে এক আনন্দভুবন।

১৯৯৮

ব্র্যাকের উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ বিস্তার লাভ করেছে সারা দেশজুড়ে। মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে আরও জোরালো ভূমিকা রাখছে ব্র্যাক। এবার সেই ধারায় যোগ হলো আরও একটি অধ্যায়- ব্র্যাক ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রোজেক্ট।

২০০১

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির পথচলা শুরু হলো।

২০০২

দেশের সীমানা পেরিয়ে, ৩০ বছর পর আবেদ ভাই আবার দায়িত্ব নিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত এক দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান বদলে দেবার, সেই দেশের মৃতপ্রায় অর্থনীতিতে প্রাণ ফিরিয়ে আনার।

আবেদ ভাই এবার হতে চাইলেন বিশ্বের দরিদ্র মানুষের পরম বন্ধু, সহমর্মিতা নিয়ে যিনি বৈষম্যহীন এক সুন্দর পৃথিবী গড়তে চান।

২০০৬

বিশ্বায়নের এই যুগে ব্র্যাক বিশ্বাস করে, বিপন্ন মানুষের কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা নেই।

আফ্রিকা মহাদেশের মানুষের জীবনে স্বপ্নদ্রষ্টা হয়ে এলেন আবেদ ভাই। অভাব যাদের পিছু ছাড়েনি কখনও, তাদের অনেকেই এবার দেখবেন এক বিপরীত বাস্তবতা। আফ্রিকার অনেক দেশের মানুষের সুখদুঃখের সঙ্গী হলেন তিনি পরবর্তী সময়ে।

২০০৯

বাংলাদেশে এবং বিশ্বজুড়ে দারিদ্র্য বিমোচন এবং দরিদ্র্য মানুষের জন্য কাজ করার স্বীকৃতিস্বরূপ আবেদ ভাই ভূষিত হলেন Knight Commander of the Most Distinguished Order of St. Michael and St. George by the British Crown

২০১৬

শূন্য থেকে, বিশাল এক স্বপ্নের শক্তিতে যে প্রতিষ্ঠানের যাত্রা হয়েছিল শুরু- ৪৪ বছর পর তা প্রথমবারের মতো বিশ্বের সর্ববৃহৎ এনজিও হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। পরবর্তীতে টানা ৫ বার এই স্বীকৃতি অর্জন করেছে ব্র্যাক।

২০১৯

তিনি হয়ে গেলেন সবার, সেই অনন্তের পথে যাত্রায়।

শুধু থেমে নেই তার যোগ্য উত্তরাধিকার হয়ে ওঠার তরে আমাদের প্রচেষ্টা- যে প্রতিজ্ঞা আমরা করেছিলাম ২০ ডিসেম্বর, ২০১৯।